হাসান আদিত্য
- সরবরাহ কমে দাম ঊর্ধ্বমুখী
- গতবছর থেকে বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে ১১৮১ মিলিমিটার-পাউবো
- বৃষ্টির কারণে আগাম শীতকালীন সবজির উৎপাদন কমেছে ২৫ শতাংশ-কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের ডিডি
- ঢাকায় পৌঁছানো খরচ কেজিপ্রতি প্রায় সাড়ে চার টাকা-পাইকারি ব্যবসায়ী
- গতবছরের তুলনায় প্রতিটি সবজি চাষে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ খরচ বেড়েছে-কৃষক সোলাইমান মুন্সী
- বৃষ্টির কারণে সবজির উৎপাদন কমলেও দাম বেশি পাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে–কৃষক আবদুল মোল্লা
সবজি জোন খ্যাত যশোরের সাতমাইল বারিনগরের হাট। এই গ্রামেরই কৃষক নুরনবী চলতি মৌসুমে সাড়ে চার বিঘা জমিতে বেগুন, মরিচ ও মুলার চাষ করেন। কিন্তু গেল জুলাই থেকে অব্যাহত বৃষ্টির কারণে তার উৎপাদিত ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, ‘এবার দুই বিঘা জমিতে বেগুন, দেড় বিঘা জমিতে মুলা আর আধা বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছি। অত্যধিক বৃষ্টির কারণে দুই দফা এই সবজির গাছগুলো রোপণ করা লেগেছে। প্রথম দফাতে প্রায় ৮০ শতাংশ বেগুন, ৬৫ শতাংশ মরিচ গাছ এবং শতভাগ মুলা গাছ নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি বলেন, বারবার সবজির চারা রোপণ করায় সবজির গাছ বড় হতে দেরি হয়েছে। তাই বাজারে আসতেও দেরি হয়েছে। এই সময়ে ভরপুর সবজি থাকার কথা থাকলেও উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে সবজি নেই। চাহিদার মতো সবজি উৎপাদন না হওয়াতে বাজারে সবজির দাম বেশি।’
দেশের চাহিদার সিংহভাগ সবজি সরবরাহ করে যশোরের চাষিরা। তবে টানা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবজির ক্ষেত ও বিজতলা। কয়েক দফায় সবজির চারা রোপণ করেও বাঁচানো যায়নি। দেরিতে রোপণ করায়, শীতের আগাম মৌসুমি সবজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বৃষ্টিতে ক্ষতির কারণে কৃষকেরা খরচ ওঠাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় সব ধরনের সবজির দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী বাজারে দ্রুতই সবজি সরবারহ বৃদ্ধি পেলে ক্রেতাদের নাগালেই থাকবে সবজির দাম।
শনিবার সদরের চুড়ামনকাটি, বারিনগর হৈবতপুর এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সবজি থাকার কথা সেখানে মাঠে সবজি কম। মাঠ জুড়ে সবজি চাষ হলেও সেগুলোতে ফলন নেই। কিছু কিছু ক্ষেতে সবজি দেখা গেলেও সেগুলো পর্যাপ্ত না। আবার কিছু কিছু জায়গায় সবজি চাষ করার জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে।
হৈবতপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে সময়ে জমিতে সবজির থাকার কথা, সেই সময়ে সবজির চাষ শুরু করছি। এতদিন বৃষ্টির কারণে আবাদ করতে পারিনি। দুই মাস ধরে জমি ফেলানো। জমিতে চাষ দিলেই বৃষ্টিতে জমির জো (মাটির উর্বরতা) নষ্ট করে দেয়।
পাশেই জুম্মন আলীর জমি। তিনি বলেন, দেড় বিঘা জমিতে মুলা লাগিয়েছি, প্রথমবার বিজ রোপণের সপ্তাহখানিক পর হাঁটু পানি জমে। এতে প্রথমবার সব মার। দ্বিতীয়বার লাগালাম, সেইবারও বৃষ্টি। পরে লাগানোর পর চারা বেঁচেছে। সেই মুলা অল্প অল্প করে বাজারে বিক্রি করছি। আমার মতো অনেকেরই মাঠে সবজি নষ্ট হওয়াতে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সবজি তুলতে পারছি না।’
দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজি বাজার যশোরের সাতমাইল-বারীনগর। যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এই সবজি হাট। বর্তমানে প্রতিদিন বসে হাটটি। তবে রোববার ও বৃহস্পতিবার বসে চাঙা হাট। শনিবার বেলা ১০ টার দিকে দেখা যায়, ছয় থেকে সাতটি ট্রাকে সবজি ওঠানোর কাজে ব্যস্ত ব্যাপারি ও শ্রমিকেরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অন্যবছরের এই সময় হাটের দিনে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাকে সবজি ওঠানো হতো। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলা শহরে এই সবজি পাঠানো হতো। এ বছর সেখানে সবজির সরবরাহ কমে গেছে।
বারীনগর মোকামে ক্ষেতের সবজি বিক্রি করা ডহেরপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল মোল্লা বলেন, বৃষ্টির কারণে এবার সবজির উৎপাদন কমে গেছে। তবে দাম বেশি পাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে যাচ্ছে। ওই বাজারের ব্যাপারি আতিয়ার রহমান বলেন, প্রায় দেড় মাস ধরে বাজারে সবজির সরবরাহ কম। বছরের এ সময় প্রতি হাট থেকে ৫০-৬০ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। আর এখন যাচ্ছে ১০ থেকে ১২ ট্রাক সবজি। বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দামও চড়া।
কৃষক সোলাইমান মুন্সী বলেন, প্রতিটি সবজি চাষে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। ফসল মারা যাওয়ার সঙ্গে গত বছরের তুলনায় এ বছর সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের খরচ বেড়েছে। আবহাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন কম হয়েছে। ফলে বাজারে যতটুকু সবজি উঠছে, তার দাম চড়া হয়ে যাচ্ছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, এ বছর অসময়ে অতিবৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজির উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। তাতে বাজারে সবজির দাম বাড়তি। তবে কৃষকেরা আগাম সবজির চাষ শুরু করেছেন। দ্রুতই সরবরাহ বাড়বে বলে আশা করা যায়।
কৃষক পর্যায়েও দাম বাড়তি
সাতমাইল পাইকারিতে কৃষকেরা প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ (দেশি) বিক্রি করেন ৪২০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই দাম ছিল ৩৯০ টাকা। একইভাবে করলার দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, বেগুনের দাম ৮০-৯০ টাকা, কাঁকরোল ৭০-৭৫, পেঁপের দাম কমে ২০-২৫ টাকা, শসা ৫৫ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, মুলা ৫০, শিম ১১৫ টাকা। এই বাজারের চট্টগামের পাইকারি এজেন্ট আনোয়ার হোসেন বলেন, যশোরে প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হচ্ছে। এতে সবজি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। হাটে এখন সবজির সরবরাহ কম। অন্যান্য বছর এ সময় শীতকালীন আগাম সবজির প্রচুর সরবরাহ থাকত। এ কারণে দাম চড়া।’
পাইকারদের তথ্যমতে, যশোরের মোকাম থেকে এক কেজি সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারে নিতে পরিবহন খরচ পড়ে ২ টাকা ৩৫ পয়সা। তার সঙ্গে শ্রমিক, মোড়কজাত বাবদ খরচ যোগ হয় কেজিতে আরও এক থেকে দুই টাকা। অর্থাৎ এক কেজি সবজি যশোর থেকে কারওয়ান বাজারে পৌঁছাতে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে চার টাকা। যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ২৭৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত বছর থেকে ১ হাজার একশ একাশি মিলিমিটার বেশি।