প্রকাশনার প্রথম বছর পূর্ণ করল দৈনিক বাংলার ভোর। দ্বিতীয় বর্ষে পদাপর্ণের এই শুভক্ষণে অগণিত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতাকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা ও গণমানুষের মুখপত্র হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পত্রিকাটির। সেই ধারাবাহিকতায় একটি বছর খুব বেশি দিনের যাত্রা নয়, আমরা যেতে চাই বহুদূর। পথচলার প্রথম বছরে পাঠকের যে সাড়া পেয়েছি, আমরা অভিভূত।
পাঠকের ভালবাসায় বাংলার ভোর এগিয়ে যাবে আপন গতিতে। আমরা নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা অব্যাহত রাখতে চাই। পাঠকই আমাদের শক্তি, আমাদের সাথী। আপনাদের শক্তিতে বলিয়ান হয়েই আমাদের পথচলা।
এই একটি বছরে আমরা চেষ্টা করেছি লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিচল থাকাতে। ঘাত-প্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে আপনাদের কাছে পৌঁছানোর। আমরা চেষ্টা করেছি পাঠকের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই সংবাদ পরিবেশনের। তুলে ধরেছি সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক দায়বদ্ধতায় অবিচল থাকার চেষ্টা করেছি।
এমন সময় পত্রিকাটির যাত্রা, যখন দেশের মানুষ বৈষম্যমুক্ত, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্যদিয়ে বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও দেশ গড়ার নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। যাদের রক্তের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় জনআকাঙখা পূরণে গণমাধ্যমের ভূমিকাও অনস¦ীকার্য। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মধ্যদিয়ে বৈষম্যবিহীন সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে চাই আমরা। সম্ভাবনার আগামীর বাংলাদেশে দৈনিক বাংলার ভোর বলিষ্ঠ কণ্ঠে গণমানুষের কথা বলবে, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।
যাত্রা শুরুর কথা
পিতার কর্মস্থল পত্রিকা জগত হওয়ায় আজন্ম পত্রিকা জগতের লোক হিসেবেই নিজেকে মনে করেছি। তারপরও ১৯৯২ সালে নিজেও সংযুক্ত হই সংবাদপত্র জগতে। ওই বছরেই পিতার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘দৈনিক ভোরের রানার’ একপ্রকার চুরি হয়ে যায় যশোর থেকে। পিতা মরহুম সৈয়দ নজমুল হোসেন অনেকটাই ভেঙে পড়েন। কলেজ জীবনে পড়া আমি বুঝি পিতার কতটা আবেগ আর স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল ওই প্রতিষ্ঠানটির সাথে। কেননা তিনি ছিলেন ওই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তবে তাঁকে কোনদিন তাঁর কোন আক্ষেপ চাওয়া পাওয়া স্বপ্ন নিয়ে কোথাও আলোচনা করতে শুনিনি।
কথার ছলে কথা বলে তিনি বুঝিয়ে দিতেন তিনি আসলে কি চান। সেভাবেই বুঝেছিলাম পিতার স্বপ্ন ছিল একটি পত্রিকা প্রকাশের। কিন্তু জীবদ্দশায় সংসারের যাতাকালে তা আর হয়ে ওঠেনি। পিতার মৃত্যুর পর আমিও অথৈ সমুদ্রে খেই হারা মাঝি হয়ে যাই। এভাবেই দিন যায়, মাস যায় করে বছর গড়াতে থাকে। ঠিক এভাবে পিতার মৃত্যুর ছয় বছর পর পারিবারিক স্থিতিশীলতা আসার পর সেই পুরনো স্বপ্ন আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এভাবে ২০২০ সালের জুন মাসে একটা কাজে আমি আর হারুন মামা (উপদেষ্টা সম্পাদক বাংলার ভোর) ঢাকায় যাই। সেখান থেকে ফেরার পথে বিমানে মামাকে বলি আমার স্বপ্নের কথা। মামা সব শুনে বলেন, তোর বড় মামার (ইকবাল কবীর জাহিদ দৈনিক সত্যপাঠ এর মালিক) মত বের করলে চলবে না। এরপর যশোর আসার পর শুরু হয় পত্রিকার নাম কি হবে তা নিয়ে আলোচনা।
এ পর্যায়ে অচেতনভাবেই পিতার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘ভোরের রানার’-এর ভোর এবং ডিজিটাল যুগে বাংলাকে দুনিয়ার বুকে তুলে ধরার মানসে আমার ছোট বোন সৈয়দা নাজমুন্নাহার শশী নাম দেয় ‘ভোরের বাংলা’। যেহেতু পত্রিকার নামের ছাড়পত্রের জন্য তিনটি নাম পাঠাতে হয় সেই মোতাবেক ‘ভোরের বাংলা’ কে প্রথমে দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নাম হিসেবে ঠিক করা হয় ‘বাংলার ভোর’ ও ‘ভোরের পাঠ’। এরপর শুরু হয় জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে কাগজপত্র যোগাড় করে আবেদন প্রক্রিয়ার। এ পর্যায়ে যে প্রথম কাগজটি দরকার তার জন্য সে সময় প্রায় ৬ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। এমতাবস্থায় সকল সুখ-দুঃখের সাথি বন্ধুবর হাফিজের সাথে আলোচনা করছি এমন সময় বন্ধুতুল্য ছোট ভাই ইব্রাহিম সেখানে হাজির। সে শুনে বলল ভাই আপনার স্বপ্ন অনেক বড় সেখানে কিছু করতে পারি আর না পারি এই ছয় হাজারের অর্ধেক আমি দিয়ে শিকড় তো লাগাই। ব্যস কয়েকদিনের ছোটাছুটিতে হয়ে গেল প্রথম কাগজটি যোগাড়।
এরপর ব্যাংকের দীর্ঘ লেনদেন এবং জমা টাকার বিষয়ে দৈনন্দিন চাহিদাটা বন্ধুবর হাফিজ নিজেই যোগাড় করে দিয়েছে। একদম শেষে যখন একাউন্টে বড় অংকের টাকা দরকার তখন কি করি। আবার হাফিজ আমি ইব্রাহিম আলোচনা। এবং সর্বশেষ বন্ধুবর কামালকে বলার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক কামালকে বলার সাথে সাথে বলল ভাই কবে লাগবে। রবি থেকে মঙ্গল দিতে পারবো না। বুধবারে হলে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি বললাম তাই হবে।
আল্লাহর অশেষ কুদরত ছাড়া কিছুই না। কেননা আমার মত একজন দিন আনি দিন খাই মানুষকে এভাবে এত বড় অংকের টাকা কেউ দেবে কোনদিন তা স্বপ্নেও ভাবিনি। যাক এবার পারিবারিক আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বেছে নেয়া হয় আমার জন্মদিনের বিশেষ দিনটিকে। সেই মোতাবেক ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জমা দেয়া হয় আবেদন। আবেদন জমা নিয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সহাস্যেই বলেছিলেন কিছু প্রক্রিয়া তো আছে, কয়েকদিন সময় লাগবে। কিন্তু তিনি দিতে পারেননি।
বন্ধুর পথ
না যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা সহজ ছিল না এ পথ । জেলা প্রশাসক মহোদয় তাঁর দেয়া কথামত দ্রুতই প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করে আবেদনটি ঢাকায় পাঠিয়ে দেন নামের ছাড়পত্রের জন্য। সেখানে যেয়ে প্রক্রিয়া শোনার পর আমি অথৈ সমুদ্রে। কেননা সারাজীবন সংবাদপত্রে কাজ করলেও পেশার জগত ছাড়া অন্য কোন জগতে আমার পরিচিতি নেই বললেই চলে। ঢাকার অত বড় অফিসে আমি তেল কিভাবে ঢালবো।
আর ফোনই বা করাবো কাকে দিয়ে। এ সময় আবারো এলো আল্লাহর রহমত। একই মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি অধিদপ্তরে এক বড় আপা আমাদের নিউমার্কেট এলাকায় বাড়ি। বহু দিন যোগাযোগ না থাকার পরও তাঁকে ফোন দিলাম। আপা বললেন আমি মিটিংয়ে আছি তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি। কিছু সময় পর আপা ফোন ব্যাক করলে তাঁকে সব বললাম। তিনি আমাকে ঢাকায় যেতে বললেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বলে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। এই সময় আমার ছোট বোন শশী তার ঢাকার এক বড় ভাই (তিনিও সংবাদপত্র জগতে কর্মরত) তার সাথে কথা বললেন। দু’জনের হাই-হ্যালোতে অল্পদিনেই পেয়ে গেলাম বংলার ভোর নামের ছাড়পত্র।
এবার আবার যশোর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গেলাম নামের ছাড়পত্র নিয়ে। জেলা প্রশাসক মহোদয় বললেন দিয়ে দেবেন শিগগিরই। কিন্তু ঠিক কি কারণে জানিনা তিনি যেদিন যেতে বললেন সেদিন যাওয়ার পর আর ফাইলটি ছাড়ার বিষয়ে কোন কথা বললেন না। এমনিভাবে দিন যেতে লাগলো। একটা সময়ে বুঝলাম তিনি ফাইলটি ছাড়বেন না। এ পর্যায়ে শুরু হলো কেন ছাড়বেন না তা খুঁজে বের করার। শুরু হলো আবার দৌঁড়াদৌঁড়ি এ দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে।
এ পর্যায়ে একে একে খুঁজে পেলাম কয়েকজন বন্ধুকে যারা জেলা প্রশাসক বা তার চেয়ে একটু উপরের পদে কর্মরত। খুঁজে পেলাম কয়েকজন বড় ভাইকে যারা আরো একটু উপরের পদে কর্মরত। এদের মাধ্যমে জানতে পারলাম কেন আমার ফাইলটি ছাড়া হচ্ছে না। তারা আমাকে জানালো জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানানো হয়েছে আমার নিঃস্বতার কথা।
বলা হয়েছে বিএনপির রাজনীতির সাথে আমার সংশ্লিষ্টতার কথা। তারপরও আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর আবারো ঢাকায় যেতে বাধ্য হলাম এবং সেখান থেকে নিয়ে আসতে পারলাম বাংলার ভোর মানুষের কাছে তুলে দেয়ার অনুমতি। তারপর ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর আমার হাতে ঘোষণাপত্র তুলে দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার। এরপর শুরু হয় প্রকাশনা শুরুর প্রক্রিয়া সেই মোতাবেক ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর ছোট্ট পরিসরে দোয়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ২৮ নভেম্বর থেকে পথচলা।
বর্তমান ডিজটাল যুগে ছাপা পত্রিকার বাজার সংকুচিত হয়েছে। এমন সময়ে ছাপা পত্রিকা হিসেবে বাংলার ভোরের যাত্রা সত্যিই চ্যালেঞ্জের ছিল। কিন্তু এক বছরের পথচলায় অসংখ্য পাঠকের ভালবাসায় সিক্ত আমরা। পাঠকের সাড়ায় আমরা অনুপ্রাণিত। ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন সংস্করণেও পত্রিকাটি পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক বছরে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। আগামীতে নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পাঠকের চাহিদা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
আজকের শুভদিনে একটাই প্রত্যাশা বাংলার ভোরের প্রতি আপনাদের সমর্থন ও ভালবাসা অব্যাহত থাকুক। শুভ কামনা রইল সবার জন্য।