# দেড় বছরে অন্তত ১৫টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ডুবি
# চার কারণে বারবার দুর্ঘটনা
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মোংলা বন্দরের হাড়বাড়িয়া থেকে এমভি সেভেন সিজ-৪ নামে কার্গো জাহাজটি ৮৫০ টন ইউরিয়া সার ঝোঝাই করে নোঙর করে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভৈরব নদের শুভরাড়া খেয়াঘাটে। ৯ ফেব্রুয়ারি শক্ত কোনো কিছুর সঙ্গে জাহাজটির তলদেশের আঘাত লেগে তলা ফেটে যায়। এতে জাহাজে পানি উঠতে থাকে। এরপর নদে জোয়ার শুরু হলে জাহাজটি ধীরে ধীরে নদের পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় জাহাজে প্রায় ৮৫০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারই ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া ইউরিয়া সারগুলো বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) আমদানি করেছিল। ঢাকার পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামিট অ্যাসোসিয়েটস সারগুলোর পরিবহন ঠিকাদার। এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি অভয়নগর উপজেলার সিদ্দিপাশা এলাকায় ভৈরব নদে গম বোঝাই এমভি ওয়েস্টার্ন-২ কার্গো জাহাজটি কাত হয়ে পানি ঢুকে নদের পানিতে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়ার সময় জাহাজে প্রায় ৭০০ মেট্রিক টন গম ছিল।
নাব্য সংকট, সরু চ্যানেল, পর্যাপ্ত নিরাপদ জেটি না থাকার কারণে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ত নদীবন্দর নওয়াপাড়া। গেল দেড় বছরে অন্তত ১৫টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। বন্দর উন্নয়নে ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সময়ে দাবি জানিয়ে আসলেও তাতে কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ। কার্গো জাহাজের মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা জানান, মূলত চার কারণে ভৈরব নদে বারবার জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে। প্রথমত নিয়মিত খনন না করায় নওয়াপাড়া নৌবন্দরের ভৈরব নদের নাব্য সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। খনন কাজ সুষম বা ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। কোথাও গভীর আবার কোথাও মোটেও খনন করা হয় না। দ্বিতীয়ত নদ দখলের কারণে ভৈরব দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অদক্ষ মাস্টার ড্রাইভার মূল চ্যানেলের বাইরে এসে নদের কিনারায় জাহাজগুলো নোঙর করে। চতুর্থত সময়মতো মেরামত না করায় পণ্যের অতিরিক্ত ওজনের চাপ সহ্য করতে না পেরে পুরোনো জাহাজের তলা ফেটে তা পানিতে তলিয়ে যায়।
জানা গেছে, মুজতখালী থেকে আফরাঘাট পর্যন্ত নওয়াপাড়া নৌবন্দরের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। গত ৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলার শুভরাড়া এলাকায় ভৈরব নদে আমদানি করা বিসিআইসির ৮৫০ টন ইউরিয়া সারবোঝাই এম ভি সেভেন সিজ-৪ কার্গো জাহাজটির তলা ফেটে ডুবে যায়। সামিট অ্যাসোসিয়েটস ওই ইউরিয়া সারের পরিবহন ঠিকাদার।
এম ভি সেভেন সিজ-৪ এর মাস্টার জুয়েল হোসেন বলেন, গতবছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অভয়নগর উপজেলা শুভরাড়া খেয়াঘাটে ভৈরব নদে কার্গো জাহাজটি নোঙর করা হয়। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি জাহাজ থেকে ইউরিয়া নামানোর সময় ভাটায় জাহাজের তলদেশের সঙ্গে মাটিতে থাকা পাথর কিংবা শক্ত কোনো বস্তুর সঙ্গে সজোরে আঘাতে জাহাজটির তলদেশ ফেটে জোয়ারের সময় জাহাজটি ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়। গত বছরের ১৩ এপ্রিল উপজেলার নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে কয়লাবোঝাই এমভি সাকিব বিভা-২ কার্গো জাহাজটি নওয়াপাড়া নোনাঘাট এলাকায় নোঙর করার সময় তলা ফেটে নদে ডুবে যায়। জাহাজে ৬৮৫ টন কয়লা ছিল। ওই কয়লা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জে এইচ এম গ্রুপ। একই বছর ১৫ জানুয়ারি উপজেলার ভাটপাড়া এলাকায় ভৈরব নদে কয়লাবোঝাই এমভি পূর্বাঞ্চল-৭ কার্গো জাহাজটি কাত হয়ে ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ৮০০ টন কয়লা ছিল। এর দুদিন আগে ১৩ জানুয়ারি বিকেলে অভয়নগর উপজেলার ধূলগ্রাম এলাকায় নদে এমভি মৌমনি-১ নামের একটি কয়লাবোঝাই কার্গো জাহাজ তলা ফেটে ডুবে যায়। জাহাজে ৭০০ টন কয়লা ছিল। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে অভয়নগর উপজেলার দেয়াপাড়া এলাকায় ভৈরব নদে এমভি আর রাজ্জাক নামের কয়লাবোঝাই জাহাজ ডুবে যায়। জাহাজে ইন্দোনেশিয়ার ৮২০ টন কয়লা ছিল।
জাহাজের এক শ্রমিক বলেন, ‘এই নদীতে আগের তুলনায় জাহাজের সংখ্যা বাড়লেও নোঙর করার জায়গা খুবই কম। পানি কম থাকায় এমন দুর্ভোগে পড়তে হয়। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে প্রাণ কেন্দ্র নোয়াপাড়া নদী বন্দর সচল ও নিরাপদ রাখাতে নিয়মিত নদী খনন ও নিরাপদ জেটি নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করনি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ বন্দর ব্যবহারকারীদের।
খুলনা নৌ-পরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সব থেকে বড় নদী কেন্দ্রিক অর্থনীতি কেন্দ্র নওয়াপড়া বন্দরের এ বেহাল অবস্থা দীর্ঘদিনের। নদীর নাব্য কম, পানি কমতে কমতে নদী ছোট হয়ে আসছে। সঠিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং করার প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা বারবার বলেছি। তবে এর সমাধান হচ্ছে না।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নওয়াপাড়া শাখার সদস্য সচিব নিয়ামুল ইসলাম রিকো বলেন, ‘নওয়াপাড়া ভৈরব নদে নাব্য সংকট প্রকট। দখলে নদ সরু হয়ে আসছে। খননকাজ সুষম বা ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। কোথাও গভীর আবার কোথাও মোটেও খনন করা হয় না। যে কারণে ঘন ঘন জাহাজ ডুবছে। নওয়াপাড়া নদীবন্দরের উপ পরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘সব নদ নদীতে নাব্য সংকট রয়েছে। ভৈরব নদে ড্রেজিং চলছে। মূলত অদক্ষ মাস্টার ড্রাইভার নিয়ম না মেনে জাহাজগুলো মূল চ্যানেলের বাইরে এসে নদের কিনারায় নোঙর করে। তা ছাড়া পুরোনো জাহাজের তলদেশ নিয়মিত ডকিং বা মেরামত না করায় অতিরিক্ত পণ্যের চাপে ভাটায় এসব জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ছে।’ খুলনা ও নওয়াপাড়া বন্দরে গড়ে প্রতিদিন পঞ্চাশটি জাহাজ নোঙর করতে পারে, আর অপেক্ষমাণ থাকে আরও শতাধিক জাহাজ। এখানে খালাস হওয়া কয়লা, সারসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলে।