এস এম জালাল
আনোয়ার হোসেন ও জাকির হোসেন দুই ভাই। যশোর শহরের হোটেলে কাজ করেন। মা-বাবা ও দুই বোন মিলে ছয় জনের সংসার। টানাপাড়েনের সংসারে আনোয়ার হোসেন বড়। ভাড়া থাকেন পোস্ট অফিস পাড়ায়। দেশের বাড়ি ভোলা। ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে সব। অভাবের কবলে পড়ে বাবা ইউসুফ চলে আসেন যশোর। শুরু হয় জীবন যুদ্ধের সংগ্রাম। অভাবের সংসারে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে না পেরে বাধ্য হয়ে দিয়েছেন শ্রমিকের কাজে। বাবা ইউসুফ এখন কাজ করতে অক্ষম। আনোয়ার হোসেনের ২০০ আর জাকির হোসেন প্রতিদিনের আয় ৩০০টাকা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করেন। এ আয় দিয়ে চলে তাদের সংসার। যেদিন কাজ নেই সেদিন টাকা নেই। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান যাই হোক প্রতিদিন কাজ করতেই হবে। ‘মে দিবস’ কি? কী কারণে এই দিনটিকে ‘মে দিবস’ বলা হয়? তা জানা নেই আনোয়ারের! কেবল জানেন, একদিন কাজ না করলে পরদিন আর পেটের ভাত জোগাড় হবে না।
স্বামী পরিত্যক্তা শ্রমিক শিউলী বেগম। দুই সন্তানকে নিয়ে ভাড়া থাকেন যশোরের রেলগেট এলাকায়। ২০ বছর ধরে কাজ করেন হোটেলে। থালা-বাসন থেকে তরকারি কাটাসহ বাবুর্চির কাজে সহযোগিতা করেন। প্রতিদিন ৩০০ টাকা আয় করেন। দেশের বাড়ি পাইকগাছা। স্বামীর মজনু হাওলাদার এখন অন্য স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছেন। দিবস কী জানতে চাইলে সরল মৃদু হাসি দিয়ে বলেন ‘এত কিছু বুঝে কী হবে বলেন, মজুরি তো আর বাড়বে না! বাড়লে বুঝে দেখতাম দিবস দিয়ে লাভ হয়, না ক্ষতি’।
একই সুরে সুর মিলিয়ে জাকির হোসেন বলেন, মে দিবস আর শ্রম দিবস কাকে বলে তা বুঝি না। আমরা বুঝি একদিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে। জীবন-জীবিকার টানে তাই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। লক্ষ্য একটাই-সারাদিন, হাড়ভাঙা খাঁটুনির পর চাল-ডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা।
শিউলী বেগম এ কাজে আসার বর্ণনা দিয়ে বলেন, স্বামী না থাকায় চরম অভাবে পড়তে হয়। সন্তানদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। উঠেন যশোর শহরের রেলগেট এলাকায়। দিশাহারা হয়ে কাজ খুঁজতে থাকি। প্রথম দিকে কখনও মাটি কাটার কাজ, কখনও ইটভাটায় কয়লা ভাঙার কাজ, আবার কখনও রাজমিস্ত্রির জোগান দিয়েছি। কারণ একই কাজ সব সময় পাওয়া যায় না। যখন যেই কাজ পান তখন সেই কাজ করেন। তার মধ্যে শারীরিক অসুস্থতা তো আছেই। তাই ছেলেদের হোটেলের কাজ করেন। এরপরও অভাব-অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। নিজের কাজ নিয়মিতি করতে শিউলীও হোটেলে কাজ বেছে নেন। বিশ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি। আগুনে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। কথা বলার এক ফাঁকে দেখা গেলো দু’চোখের কোণে পানি টলমল করছে। বার বার মাথার ঘোমটা টেনে তা দিয়ে পানি মোছার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে চাপা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিউলী বলেন- কাজের ঠিক নেই, শরীরের আরাম নেই, কি হবে দিবস দিয়ে। কিসের দিবস, দিবস দিয়ে পেট ভরে না। মজুরদের কথা এখন কেউ ভাবে না। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।
নির্মাণ শ্রমিক রাসেল হোসেন বলেন, রোদে পুড়ে কাজ করি। কিন্তু ন্যায্য মজুরি পাই না। সকাল ৭টায় কাজ শুরু করি শেষ করার কোনো সময় নেয়। ঠিকাদার যতক্ষণ মনে করেন কাজ করান। কিন্তু বেশি কাজ করলেও বেশি টাকা দেয় না। প্রতিবাদ করলেই বাদ দিয়ে দেয়। তাই দিন শেষে মজুরি ওই ৪০০ টাকাই। এ দিয়ে চাল-ডাল, তরি-তরকারি কিনতে গেলে পকেটে আর টাকা থাকে না। এভাবেই দিন যায়, বছর ঘুরে কিন্তু বাজারে সব কিছুর দাম বাড়লেও মজুরের মজুরি বাড়ে না’।
যশোরে গড়ে উঠা প্রায় দুইশত চাতালে জীবিকা নির্বাহ করছে এ অঞ্চলের হাজারো দরিদ্র নারী। এমনই একজন কেশবপুর উপজেলার গোপসেনা গ্রামের নারী আঞ্জু বেগম। কৈশরের বিয়ে ও দুটি সন্তান জন্মের পর বিধবা হন তিনি। নাবালক সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা আঞ্জু কয়েক দিন অর্ধাহারে-অনাহারে কাটান। পরে প্রতিবেশীর সহযোগিতায় তিন বছর আগে কাজ নেন চাতালে। সেই থেকে জীবন সংগ্রামে আজ অবধি চাতালকন্যা তিনি। কিন্তু ঘুরেনি ভাগ্যের চাকা।
শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নির্মাণ শ্রমিক, ওয়েল্ডিং কারখানার শ্রমিক, মাটি কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়। সবার ভাষ্যপ্রায় একই। তারা জানান, মে দিবস তাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়। এ দিবসের তাৎপর্য কী তা বেশিরভাগ শ্রমিকই জানেন না। তাই তো মে দিবসেও তারা পেটের তাগিদে কাজ করে থাকেন। কারণ তারা সবাই দিন আনে দিন খান। কাজ না করলে স্ত্রী-সন্তান অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটান। কাজ যেমনই হোক তার মূল্য বেশি। আর সবদিনই তাদের কাছে সমান।
যশোরের হোটেল-রেস্টুরেন্ট-মিস্টি বেকারি শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি তাইজুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকরা আজো তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ১৪০তম মে দিবসে তাদের দাবি ৮ ঘন্টা শ্রম বিনিময়ে বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ বাঁচারমত জাতীয় ন্যুনতম মূল মজুরি ৩০ হাজার টাকা ঘোষণা, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, দ্রব্যমূল্য কমানো, সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা। তা নাহলে ন্যায়সংগত দাবিতে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে।