কাজী নূর
সোমবার ভোর ৬টা। যশোর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত একদল নারীর হাকডাক। ওঠেন, সবাই দ্রুত ওঠেন। রেডি হোন। থেরাপি নেয়ার সময় হয়ে গেছে। তারা রোগীদের জাগিয়ে তুলে ফিজিওথেরাপি দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় ১১ জনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন হাসপাতালে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য সোহেল রানা।
এই চিত্র শুধু সোমবার সকালের নয়। প্রতিদিন ভোরে বেসরকারি ফিজিওথেরাপি সেন্টারের কর্মীরা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে হানা দেয়। তারা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জোরপূর্বক ফিজিওথেরাপি দিয়ে মাথাপিছু ৩শ’ টাকা করে আদায় করেন। ‘আ’ ও ‘দ’ আদ্যাক্ষরের দুই সাংবাদিক নামধারী এক শ্রেণির দালাল এই ফিজিওথেরাপি সিণ্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। যাদের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জিম্মি। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে যারা নিজেদেরকে শাহীন চাকলাদারের প্রতিনিধি পরিচয়ে সারা হাসপাতালে দাপট দেখাতো। বর্তমান সময়ে তারাই এ সিণ্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে আটক ১১ নারীকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের মাঝে। তবে এ আটক ও মুচলেকা নেয়ার বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মুচলেকায় স্বাক্ষর করা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মালিকরা।
জানতে চাইলে যশোর জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত পুলিশ সদস্য (কনস্টেবল) সোহেল রানা বলেন, প্রতিদিন ভোরে বেসরকারি মালিকানাধীন ফিজিওথেরাপি সেন্টারের একদল কর্মী জেনারেল হাসাপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের জোরপূর্বক ফিজিওথেরাপি দেন। সেবা বাবদ তারা রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৩শ’ টাকা আদায় করেন। অনেক রোগী জানতেন না ফিজিওথেরাপি কি বা সেটি তার প্রয়োজন আছে কি না। আবার অনেকে মনে করেন সরকারি হাসপাতালের সেবার একটি অংশ। তারা তর্কে না গিয়ে নীরবে চাহিদা মাফিক টাকা দিয়ে দেন। বিপত্তি ঘটে হতদরিদ্র রোগীর বেলায়। ৩শ’ টাকা দিতে আপারগ হলে চড়াও হন ওই চক্রের সদস্যরা। প্রায়ই এমন অভিযোগ আসতে থাকে।
রোগীর স্বজনরা জানান, প্রতিদিন ভোরে সাদা এপ্রোন গায়ে অন্তত ১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ নারী সিণ্ডিকেট হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রবেশ করে রোগীদের জোরপূর্বক ফিজিওথেরাপি দিয়ে টাকা আদায় করে। রোগীরা ভাবেন যেহেতু তাদের শরীরে সাদা এপ্রোন রয়েছে তারা নিশ্চয়ই হাসপাতালের নার্স বা সংশ্লিষ্ট কেউ। ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটে যখন হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা ঘুমিয়ে থাকে।
সোহেল রানা বলেন, রোগীর স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার ভোর ৬টার দিকে ৪টি প্রতিষ্ঠানের ১১ নারী সদস্যকে হাতেনাতে ধরতে সক্ষম হই। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায় সিণ্ডিকেটের আরো কিছু সদস্য। যাদের মধ্যে ওই দুই হোতাও রয়েছে। এ সময় ফিজিওথেরাপির বিভিন্ন কিটসহ ৮টি ব্যাগ জব্দ করা হয়।
জানা গেছে, হাসপাতাল তত্বাবধায়কের কাছে মুচলেকা দিয়ে আটক নারীদের ও ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে ফিজিওথেরাপি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। মুচলেকায় স্বাক্ষর করেছেন, সেবা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মালিক মোছাম্মৎ তানজিলা পারভীন, হিউম্যান এডুকেশন ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজড ফিজিওথেরাপি সেন্টারের শারমিন সুলতানা, মেঘনা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের গোলাম রসুল ও সোনালী ফিজিওথেরাপি সেন্টারের সোনালী সরকার।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফিজিওথেরাপি দেয়ার জন্য হাসপাতালের নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়াদের রোগী প্রতি একশ’ টাকা ঘুস দিতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সকালের নাস্তা কিনে দিতে হয়। তাদের চাহিদা না মেটাতে পারলে ওয়ার্ডে কাজ করতে দেয় না। তাদেরকে ম্যানেজ করার জন্য হাসপাতালের এক শ্রেণির দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে।
এ বিষয়ে সেবা ফিজিওথেরাপি সেন্টারের মালিক মোছাম্মৎ তানজিলা পারভীন বলেন, এ হাসপাতালে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতালসহ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির প্রতিনিধিরা কাজ করে। সবার জন্য উন্মুক্ত হাসপাতালে কেবল আমাদের ক্ষেত্রেই এ বৈষম্য করা হল।’
তানজিলা পারভীন আরো বলেন, খুব অভাবী পরিবার না হলে কোন মেয়ে ফিজিওথেরাপি পেশায় আসে না ভাই। খোঁজ নিয়ে দেখেন আমার এখানে বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এমন অনেকে কাজ করেন, যারা স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা। অনেকে দু একটি সন্তান নিয়ে এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ এমন অভাবীদের পেটে লাথি মরা হল।’
জানতে চাইলে যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকের অনুমতি না নিয়ে রোগীকে ফিজিওথেরাপি দেয়া বেআইনি। কারণ অপ্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি দেয়ার ফলে অনেক রোগী ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যার শরীরে ফিজিওথেরাপি দেয়া প্রয়োজন নেই, এটা তার জন্য ক্ষতিকর। তার উপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই এদের ৩শ’ টাকা দেয়া রোগী সাধারণের জন্য বিব্রতকর এবং সহজসাধ্য নয়।
ডা. হুসাইন শাফায়াত আরো বলেন, ভোরে হাসপাতাল পুলিশ ওয়ার্ড থেকে কয়েকজনকে আটক করে পরে প্রতিষ্ঠান মালিকদের ডেকে সতর্ক করে মুচলেকা নিয়ে শেষবারের মতো ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাদের থানায় চালান দেয়া হবে।

