♦ বিজয়ের গৌরব, স্বাধীনতার চেতনা ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে অর্জিত বিজয় কেবল ইতিহাস নয়-এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি চলমান অঙ্গীকার।
♦ বিজয়ের ৫৩ বছরেও স্বাধীনতার মানে ও চর্চা নিয়ে আত্মসমালোচনার প্রয়োজন ফুরায়নি।
শরিফুল ইসলাম
একটি জাতির ইতিহাসে কিছু দিন থাকে, যা কেবল স্মৃতির অংশ নয়-সেগুলো জাতির চিন্তা, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে। ১৬ই ডিসেম্বর তেমনই একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল বহুল কাঙ্ক্ষিত বিজয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। এই বিজয় ছিল শুধু একটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়; এটি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে একটি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা।
মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ছিল ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতার অর্থ তখন কেবল ভৌগোলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ ছিল না; এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, সমতা এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিজয় দিবস সেই মৌলিক প্রত্যাশার কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কারণেই বিজয় দিবসের তাৎপর্য শুধু অতীত স্মরণে নয়, বর্তমান মূল্যায়নেও নিহিত।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকের বেশি সময় পর আজ দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ওঠে-আমরা সেই প্রত্যাশাগুলো কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? একটি রাষ্ট্রের অগ্রগতি কেবল অর্থনৈতিক সূচক বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক সহনশীলতা, বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং মতপ্রকাশের পরিবেশ—এসব বিষয়ই একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে। বিজয় দিবস এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে আনে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, স্বাধীনতা কোনো স্থায়ী অর্জন নয়। এটি প্রতিনিয়ত চর্চা ও রক্ষার বিষয়। যে রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনতার পর জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ও সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। বিজয় দিবস তাই কেবল আনুষ্ঠানিক উদযাপনের নয়, বরং সতর্কতার দিনও। এই দিনে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য আত্মসমালোচনার সুযোগ তৈরি হয়।
একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখা জরুরি যে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় কোনো একক দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির একচেটিয়া সম্পদ নয়। এটি ছিল সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত সংগ্রাম। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণেই এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হলে তার সার্বজনীন চরিত্র ক্ষুণ্ন হয়। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থেই বিজয়ের ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিতে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
বিজয় দিবস আমাদের সামনে সহনশীলতার প্রশ্নও তুলে ধরে। গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক। মতের পার্থক্যকে দমন নয়, বরং যুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নাগরিকরা ভয়হীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বিজয় দিবস সেই মূল্যবোধের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই দিনে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না হলেও এর চেতনা ধারণ করা তাদের নাগরিক দায়িত্ব। ইতিহাস জানা, সমালোচনামূলক চিন্তা চর্চা এবং দায়িত্বশীল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই তারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে। বিজয় দিবস তরুণদের জন্য কেবল অতীত জানার নয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণের অনুপ্রেরণাও।
সবশেষে বলা যায়, ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের গৌরবের দিন। তবে এই গৌরব তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা দায়িত্ববোধের সঙ্গে যুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ—ন্যায়, সমতা ও গণতন্ত্র—বাস্তব জীবনে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, সে প্রশ্ন তোলাই বিজয় দিবসের প্রকৃত শিক্ষা। অতীতের ত্যাগকে সম্মান জানিয়ে বর্তমানকে পরিশুদ্ধ এবং ভবিষ্যৎকে আরও মানবিক করার অঙ্গীকারই এই দিনের মূল তাৎপর্য।
লেখক : অন-লাইন ইনচার্জ, বাংলার ভোর

