বাংলার ভোর ডেস্ক
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে প্রিয় মাতৃভূমিতে পা রেখেই মাটি স্পর্শ করে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় এই অসাধারণ দৃশ্য দিয়েই শুরু হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন।
বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় পৌঁছানোর পর থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত পরিণত হয় রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়ে।
রাজধানীর ৩০০ ফিট (জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে) এলাকায় আয়োজিত গণসংবর্ধনায় তার কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হলো “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর মাই পিপল, ফর মাই কান্ট্রি।”
মাটি স্পর্শ করে দেশে ফেরা
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে লন্ডন থেকে আগত তারেক রহমানকে বহনকারী বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
ইমিগ্রেশন ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দর এলাকায় তিনি মাটিতে নেমে প্রথমেই মাথা নত করে মাটি স্পর্শ করেন।
সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত নেতাকর্মীদের চোখে ভেসে ওঠে আবেগের জল। দীর্ঘ ১৭ বছর পর নেতার এই প্রত্যাবর্তন শুধু রাজনৈতিক নয়, আবেগঘন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে রূপ নেয়।
বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফুল দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।
পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও আলিঙ্গন করেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও একমাত্র কন্যা জাইমা রহমান।
বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিট: তিন ঘণ্টার জনস্রোত
দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে বিশেষ বাসে করে তারেক রহমান ৩০০ ফিটের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু রাস্তার দুই পাশে মানুষের ঢল নেমে আসে।
কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, নামাপাড়া, পূর্বাচল, নীলা মার্কেট-প্রতিটি অলিগলি মানুষের উপস্থিতিতে ভরে যায়। ওভারব্রিজ, ভবনের ছাদ, যানবাহনের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ নেতাকে একনজর দেখতে চায়।
এই জনসমুদ্র ঠেলে সংবর্ধনাস্থলে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন ঘণ্টারও বেশি। বিকেল সাড়ে ৩টা ৫০ মিনিটে মঞ্চে ওঠেন তারেক রহমান। মুহূর্তেই স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
বিকাল ৩টা ৫৮ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে তারেক রহমান বলেন, “প্রথমেই আমি রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাজারো লক্ষ-কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। তাঁর অশেষ রহমতে আজ আমি আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছি আপনাদের মাঝে।”
আরও পড়ুন .. .. যশোরের ৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ঘোষণা
এরপর তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব, ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন এবং ২০২৪ সালের আন্দোলনের কথা স্মরণ করেন। তার ভাষায়, প্রতিবারই এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে।
তারেক রহমান বলেন, “আজ বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা চায়-যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এখন সময় এসেছে সবাই মিলে দেশ গড়ার।
আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান: কী এই পরিকল্পনা
মার্টিন লুথার কিংয়ের ঐতিহাসিক উক্তি স্মরণ করে তিনি বলেন, “আপনারা মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ শুনেছেন।
আজ বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি বলতে চাই-আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্য পিপল অফ মাই কান্ট্রি।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই পরিকল্পনা দেশের মানুষের স্বার্থে, উন্নয়নের জন্য এবং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য।
তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের সহযোগিতা।
তারেক রহমান বলেন, “এই দেশে পাহাড়ের মানুষ আছে, সমতলের মানুষ আছে।
মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সবাই আছে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, যে বাংলাদেশ একজন মা দেখেন-একটি নিরাপদ বাংলাদেশ।”
তিনি বলেন, নারী, পুরুষ, শিশু—যেই হোক না কেন, যেন নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারে।
বিভিন্ন আধিপত্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধৈর্য ধরতে হবে।
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দেশ গড়ার দায়িত্ব আজ থেকেই তরুণদের নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে নিহত ওসমান হাদির কথা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, তিনি ছিলেন ২৪-এর আন্দোলনের সাহসী সৈনিক। “৭১, ২৪ এবং স্বৈরাচারের সময় যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়তেই হবে।”
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে মহানবী (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ অনুসরণ করে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। যেকোনো মূল্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে এবং যেকোনো উসকানি পরিহার করতে হবে।
বক্তব্যের শেষদিকে তিনি আবেগ ভরে বলেন, “আজ এখান থেকে আমি আমার মা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যাব। সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে দোয়া চাই আল্লাহ যেন তাকে সুস্থতা দান করেন।”
বক্তব্যের শেষাংশে তারেক রহমান বলেন, “আমরা দেশে শান্তি চাই। আসুন সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি—যেকোনো মূল্যে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করব।
ইনশাআল্লাহ আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।”
‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিন্দাবাদ’ এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার দীর্ঘ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ
মাটি স্পর্শ করে দেশে ফেরা থেকে শুরু করে জনসমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ ঘোষণা-সব মিলিয়ে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং বিএনপির রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
‘প্রত্যাশিত বাংলাদেশ’-এর যে রূপরেখা তিনি তুলে ধরেছেন, তা আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

