রফিকুল ইসলাম বিপ্লব, কেশবপুর
কালের বিবর্তনে কেশবপুর অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে হারিকেন আলোর বাতি। কথায় আছে
যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি’-করুণ এই আকুতি এখন হারিকেন বাতির। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে হারিকেন বাতি। এক সময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আলোর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হতো হারিকেন। হারিকেন জ্বালিয়ে রাতে হাট-বাজারে যেত গ্রামের মানুষ। দোকানিরা বেচাকেনাও করত হারিকেনের আলোতে। অমাবশ্যার রাতে ঘোর অন্ধকারে হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পথ চলার স্মৃতি এখনো বহু মানুষ মনে করে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন শুধুই স্মৃতি। নতুন প্রজন্ম হয়তো হারিকেন সম্পর্কে জানবেই না। পড়বে ইতিহাসের পাতায় অথবা শুনবে গল্প দাদা দাদীর মুখে। আর দেখা মিলবে শুধু জাদুঘরে।
ক্রমেই বিলীন হয়ে যাওয়া আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শনটি এক যুগ আগেও রাতের আঁধারে রাস্তা পারাপার থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে অপরিহার্য্য ছিলো। তখন গ্রামে-গঞ্জে হারিকেন মেরামত করা মিস্ত্রীদের হাক শোনা যেতো। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হারিকেন মেরামত করতেন। হারিকেন হচ্ছে জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বদ্ধ কাচের পাত্রে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা। এর বাহিরের অংশে অর্ধবৃত্তাকার কাচের অংশ থাকে যাকে বাঙালিরা চিমনি থাকে এবং তার ভিতরে থাকে তেল শুষে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আলো জ্বালাবার জন্য সূতার পৈলতা। আর সম্পূর্ণ হারিকেন বহন করবার জন্য এর বহিরাংশে একটি লোহার ধরুনি বা আংটা থাকে। আলো কমানো বা বাড়ানোর জন্য নিম্নাংশে থাকে একটি চাকতি বা চাবি। ঠিক কত কাল আগে থেকে এর ব্যবহার শুরু হয় তার কোন সঠিক ইতিহাস নেই। তবে বাংলায় সম্ভবত মোগল আমলের আগে থেকে হারিকেনের ব্যবহার শুরু হয়। বাঙালির জীবনে রাতের অন্ধকার দূর করতে একসময় গ্রামের মানুষের অন্যতম ভরসা ছিল হারিকেন। এটি জ্বালিয়েই বাড়ির উঠানে কিংবা বারান্দায় পড়াশোনা করতো শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের কাচের চিমনি খুলে, ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন জ্বালানো ছিল বাড়ির গৃহিনীদের অন্যতম কাজ। হারিকেনের কেরোসিন তেল রাখার জন্য গ্রামের সব বাড়িতেই কাচের ও প্লাস্টিকের বোতলে গলায় রশি লাগিয়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হতো। আজ আর গাঁয়ের কোন বাড়িতেই দেখা মেলেনা হারিকেন বা তেলের পটের। এমনকি বাজারের দোকানগুলোতেও সহজলভ্য নয় কেরোসিন তেল।
১৮৫৩ সালে প্রথম আধুনিক কেরোসিন বাতিটি পোলিশ উদ্ভাবক ইগনাসি লাউকাসিউইচ আবিস্কার করেন। একই সময়ে,আমেরিকান ব্যবসায়ী রবার্ট ডায়েটজ এবং তার ভাই প্রথম কার্যকরী ফ্ল্যাট উইক বার্নার পেটেন্ট করেছিলেন যা বিশেষভাবে কেরোসিনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। উভয় ধরনের কেরোসিন ল্যাম্পই সুবিধাজনকভাবে বহনযোগ্য ছিল। কেরোসিনের পাত্রে এবং আলোর উৎসের জন্য পৈলতা কাচের গ্লোব দিয়ে সুরক্ষিত।
কথা হলো কেশবপুর উপজেলার আব্দুল মালেক মোড়লের (৬৭) সাথে। তিনি জানান, ছোটবেলায় আমরা হারিকেনের আলোতে লেখাপড়া করেছি। তখন ভাল হারিকেন ছিল বায়েজিদ ও তাজ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হারিকেন ছাড়েনি। একসময় হারিকেন জ্বালানোর জন্য টোল দোকানে দোকানে কেরসিন দিয়ে যেত, আবার হাটের শেষে টাকা নিয়ে যেত। কেশবপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুর রহমান জানান, ঘরে ঘরে, রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে এখন বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির উৎকর্ষে হারিকেনের পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে বিদ্যুৎ, সোলারপ্লান্ট এবং চার্জারলাইট। বিজ্ঞান প্রযুক্তি, আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামাঞ্চলের সেই ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এখন বিলুপ্তির পথে। এখনো দু-এক বাড়িতে হারিকেন পাওয়া গেলেও ব্যবহার না করায় সেগুলোতে ময়লা ও মরিচা পড়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী অতি ব্যবহার্য জিনিসটি টিকিয়ে রাখার দাবি অনেকেরই। নয়তো এক সময় চিরতরে বিলুপ্ত হবে গ্রামীণ আলোর অন্যতম বাহন হারিকেন। বিদ্যানন্দকাটি গ্রামের সুধীর ঘোষ জানান, মঙ্গলকোট বাজারে আগে সন্ধ্যা নামলে জ্বালানি কেরোসিন তেল নেয়ার জন্য মানুষের সিরিয়াল থাকতো। মঙ্গলকোট বাজারে সবচেয়ে বড় দোকান ছিল প্রয়াত অজিত কুমার হালদারের। দোকানের একপাশে তার ভাই প্রয়াত সতীশ কুমার হালদার শুধু কেরোসিন ও ভোজ্য তেল বিক্রি করতেন। লাইন দিয়ে সাজানো থাকতো কেরোসিন তেলের বোতল। আর এখন তো পুরো বাজারে মুদির দোকানে কেরোসিন তেল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তদুপরিও কেশবপুরে হারিকেন যা দুই-চারটি আছে তা এখন শুধুই স্মৃতি।
শিরোনাম:
- আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কম্বল বিতরণ
- দেয়াড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের কম্বল বিতরণ
- জমকালো ও ব্যতিক্রমী আয়োজনে সম্পন্ন হলো নান্দিকের ‘চারুসঙ্গ ২৪
- যশোরের মুখ উজ্জ্বল করা তামিমের হাত ধরেই আসবে বিশ্বকাপ : জেলা প্রশাসক
- যশোরে কর্মী সম্মেলন সফল করতে জামায়াতের মিছিল ও লিফলেট বিতরণ
- ঝিকরগাছা অবহতিকরণ সভা অনুষ্ঠিত
- কালীগঞ্জে আন্তঃইউনিয়ন ভলিবলে জামাল ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়ন
- খুলনায় সাউণ্ড লাইট ব্যবসায়ীর উপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন