হাসান আদিত্য
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যস্ততম যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮কিলোমিটার মেরামতে এক দশকে ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এই সময়ের মধ্যে সাত দফায় সড়ক সংস্কারেও মেলেনি সুফল। অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় টেকেনি সড়কটি। যতবার মেরামত হয়েছে, ততবারই সড়কে সৃষ্টি হয়েছে উঁচু-নিচু, খানাখন্দ। ফলে সারা বছরই গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে চলাচল করতে হয় ভোগান্তি নিয়ে। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের দায় এড়াচ্ছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ। এদিকে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে বারবার কাজ।
এদিকে, অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ঠেকাতে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়ায় ওজনস্কেল স্থাপন করা হলেও সেটি চালুর মাত্র ৩দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে ওয়ে স্কেলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ। সওজ বিভাগ বলছে, স্কেলটি স্থাপন করা হলেও স্থানীয় ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক সমিতির আপত্তির মুখে চালু করে আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সরকারি প্রকল্পটির প্রায় দেড় কোটি টাকা বিফলে গেছে।
এ ব্যাপারে যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘নতুন হওয়া সড়ক পাঁচ মাসও যায়নি। তার মধ্যে এমন ফুলেফেঁপে ওঠা কখনো দেখিনি। আগে ঘষেমেজে আঁকাবাঁকা ঠিক করা হয়েছিল। বছরের পর বছর এই সড়কে কাজ করায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজে অনিয়ম করায় এমনটি হয়েছে। সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও সড়কের মান উন্নয়ন করতে পারেনি।’

তোফাজ্জেল হোসেন নামে এক ট্রাক ড্রাইভার বলেন, ‘১০ বছর ধরে দেখছি রাস্তা ঠিক করছে। ঠিকই হচ্ছে না। পণ্য নিয়ে চলাচল করতে গেলে ট্রাক হেলেদোলে। ধীরে ধীরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়।’
স্থানীয় বসুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সালেক হোসেন বলেন, ‘এই সড়কটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নওয়াপাড়া নৌবন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহন হয়। যশোর-খুলনা মহাসড়কে রাটিংয়ের কারণে প্রায়ই পণ্যবোঝাই ট্রাক উল্টে যায়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে রাস্তা নির্মাণের কারণে এমন অবস্থা।’
নজরুল ইসলাম নামের এক ট্রাকচালক বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যশোর শহরের পালবাড়ী থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত। কিছু কিছু জায়গায় বিটুমিন উঠে গেছে। ভারি পণ্য নিয়ে যাতায়াতের সময় ট্রাক হেলেদুলে চলে।’
যশোরের বামগণতান্ত্রিক নেতা ও নাগরিক কমিটির সদস্য তসলিমুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অর্থের নিদারুণ অপচয় সেটা যশোর খুলনা মহাসড়কের কাজ দেখলে বুঝা যায়। এক দশকে কোটি কোটি টাকা সরকার খরচ করেছে, সেখানে ঠিকাদার ও সওজের কর্মকর্তা লুটপাট করেছে। সড়ক উন্নয়নের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতি মানেনি। তারা গোঁজামিল দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করেছে বলেই সড়কের এই অবস্থা।’
এদিকে, সর্বশেষ মহাসড়কটির ১৬ কিলোমিটার অংশ ঢালাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সাড়ে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। যেসব ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কাজ নিয়ে ছিল অভিযোগ; ফের তারাই করছেন এ কাজটিও।
অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ঠেকাতে দেড় কোটির ওয়ে স্কেল প্রকল্প বিফলে:
অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ঠেকাতে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়ায় ওজনস্কেল স্থাপন করা হলেও সেটি চালুর মাত্র ৩দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে ওয়ে স্কেলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ। সওজ বিভাগ বলছে, স্কেলটি স্থাপন করা হলেও স্থানীয় ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক সমিতির আপত্তির মুখে চালু করে আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সরকারি প্রকল্পটির প্রায় দেড় কোটি টাকা বিফলে গেছে।
একজন ট্রাকচালক বলেন, ‘আমরা নওয়াপাড়া থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে সারা দেশে পৌঁছে দিয়ে থাকি। যেখান থেকে পণ্য বোঝাই করি, সেখানেই ওজন করে গাড়িতে তোলা হয়। ওয়ে স্কেল থাকলে তো ভালো। কয়েক দিন এই ওয়ে স্কেল চালু হলে ট্রাকে সড়কের নির্ধারিত পণ্যের তালিকার বাইরে বেশি পণ্য কেউ নিতে পারতেন না।’
এদিকে, কাজের মান নিয়ে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে সড়কে মাটি ফেলা ও ওভারলোডের যানবাহন চলাচল সড়কটির বেহাল দশার জন্য দায়ী করলেন সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, সড়ক টেকসই না হওয়ার জন্য শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা সওজকে দায়ী করলে চলবে না। যারা ধারণক্ষমতার চেয়ে ভারী যানবাহন চালান, তারা কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও দায়ী।