বাংলার ভোর ডেস্ক
ক্ষমতার পট পরিবর্তনে পালাবদলের ঢেউয়ে এবার কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকেও সরে যেতে হল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা এ কমিশন মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর বাকি থাকতেই সাংবিধানিক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিল।
বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমিসহ মাননীয় কমিশনারগণ দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা অদ্যই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিব মহোদয়ের কাছে দেব।
দুই নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান ও সাবেক আমলা মো. আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে সিইসির সঙ্গে ছিলেন। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান অনুপস্থিত ছিলেন।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল। তার নেতৃত্বে এ কমিশনের পরিচালনায় এ বছর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। এছাড়া এ আড়াই বছরে দেড় সহস্রাধিক বিভিন্ন নির্বাচন করেছে কমিশন।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে ৮ অগাস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করে। ৬ অগাস্ট সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
রাষ্ট্র সংস্কারের আহ্বানের মধ্যে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে সরে যেতে হয় প্রধান বিচারপতিকে, পদ ছেড়ে দেন বিভিন্ন বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ আরও অনেকে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। এবার সেই তালিকায় যোগ হল হাবিবুল আউয়াল কমিশনের নাম।
বাংলাদেশে মেয়াদপূর্তির আগে পুরো কমিশনের বিদায় নেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে বিদায় নিতে হয়েছিল বিচারপতি এম এ আজিজ নেতৃত্বাধীন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনকে।
সিইসির দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ্যে মো. ইদ্রিস ও এটিএম মাসউদ এবং সাবেক আমলাদের মধ্যে এম এ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনে দীর্ঘদিন কোনো আইন ছিল না। ২০২২ সালে নতুন কমিশন গঠনের আগে আকস্মিকভাবেই আইন প্রণয়ন হয়, আর সেই আইনের অধীনে প্রথম নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নেন কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পাঁচজন।
তাদের মধ্যে হাবিবুল আউয়াল এক সময় সরকারের আইন সচিব ছিলেন। পরে ধর্ম সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্যে আহসান হাবিব খান একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। রাশেদা সুলতানা অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ। আর মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সচিব।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে হাবিবুল আউয়াল কমিশনকেও যে সরে যেতে হবে, তা অনুমিতই ছিল। বুধবার যখন জানানো হল যে বৃহস্পতিবার সিইসি সংবাদ সম্মেলনে আসছেন, তখনই অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে তাদের পদত্যাগের ঘোষণা আসছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিনের হবে, আর নির্বাচনই বা কবে হবে, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। আওয়াল কমিশনের পদত্যাগের ফলে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে তাদের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার আগে কাজী হাবিবুল আউয়াল বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১ এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সুক্ষ্ম বা স্থুল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্বেও, সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
“২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সাথে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের মত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না’।
“২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। আসন পেয়েছিল মাত্র ৬টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।”
কিন্তু নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করার মত সাংবিধানিক এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের ছিল না মন্তব্য করে বিদায়ী সিইসি বলেন, “সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে তাও সংবিধানে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে। দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।”
হাবিবুল আউয়াল বলেন, “নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সকল দোষ বা দায়- দায়িত্ব সকল সময় কেবল নির্বাচন কমিশনের উপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সকল সময় সকল কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে।
“বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।”
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচন মূলতঃ একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি। উইদিন হয়েছে, নট বিটুইন।”
দলীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে মন্তব্য করে বিদায়ী সিইসি বলেন, “এটি সঠিক ও যৗক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন উদাহরণ নেই।
“সরকার বারবার বলছেন, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।”
হাবিবুল আউয়াল বলেন, বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাব সরকারের বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া তিনি ‘কর্তব্য’ মনে করছেন।
তার ভাষায়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ‘সমরূপতার’ কারণে এখানে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয় ভিত্তিক) নির্বাচন ব্যবস্থা আদর্শ হতে পারে।
“সেই সাথে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে ৩/৫ দিনের বিরতি রেখে, অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে।”
বিদায়ী কমিশন অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা অব্যাহত রেখে নির্বাচন পক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “অধিকন্তু প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরো সুনিশ্চিত হতে পারে।”
Subscribe to Updates
শিরোনাম:
- গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে জেকে বসেছে শীত
- পুনশ্চ’র ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত
- শীতে বাড়ছে রোগীর চাপ নাজুক চিকিৎসা সেবা
- মাগুরায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত
- যশোরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষায় সভা
- সাজা শেষে দেশে ফিরলেন ২ ভারতীয়
- শালিখার চিকিৎসা নিতে আসা অজ্ঞাত বৃদ্ধার মরদেহ উদ্ধার
- বিশ্ব ইজতেমায় হামলার প্রতিবাদে যশোরে বিক্ষোভ