বাংলার ভোর প্রতিবেদক
নাব্য ফিরিয়ে আনতে শুরু হচ্ছে ভবদহ অঞ্চলের পাঁচটি নদীর ৮১.৫ কিলোমিটার পুনঃখননের কাজ। শুক্রবার ভবদহের ২১ ভেল্ট এলাকা থেকে ১৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনঃখনের কাজ শুরু করবে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এই অঞ্চলের স্থানীয় জলাবদ্ধতার অবসানের সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় জনগণ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ (পাউবো) সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ভবদহের আমডাঙ্গা খাল খনন ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের ৪৯ কোটি টাকার অনুমোদন দেয় সরকার।
যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানিনিস্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ নাব্যতা হারিয়েছে।
এতে নদী দিয়ে পানি নিস্কাশিত হয় না। দীর্ঘ চার দশক ধরে স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। অবর্ণনীয় দুঃখের মধ্যে চলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন। যে কারণে ভবদহকে ‘যশোরের দুঃখ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। গেল বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিতে ভবদহের আড়াই শ’ গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় চার লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সড়কের ওপর। বর্ষা মৌসুমে গেলেও এখনও প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে হাটু পানি। ডুবে আছে ঘের, ফসলি জমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটি ও স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘ ৪৪ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। ভবদহ স্লুইস গেট প্রস্তাবসহ নদী পানি ব্যবস্থাপনার প্রাকৃতিক ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ এর কারণ। এই জনপদে ভবদহ স্লুইস গেট একটি মরণফাঁদ। এর কোনো কার্যকারিতা এবং তার পানি নিস্কাশনের ক্ষমতাও নেই। পাম্পের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ২০০-৩০০ ফুট প্রশস্ত ও সুগভীর নদী হত্যা করা হয়েছে। ৪৪ বছরে সংস্কারের নামে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও ঠিকাদার চক্রের সিন্ডিকেট লুটপাটের সুবিধার্থেই তা করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তবর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা রিজওয়ান হাসান সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কর্মকর্তাদের নিয়ে দু’ দফা পরিদর্শন করেন ভবদহ অঞ্চল। এসে প্রতিশ্রুতি দেন স্থায়ী সমাধানের। জলাবদ্ধতার স্থায়ী সংকটের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও চার দশকের দুঃখ ঘোচাতে সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর যশোর ও খুলনার ভবদহ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসনে বাপাউবো এবং সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ১৪০ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রকল্পের আওতায় যশোর ও খুলনা অঞ্চলের হরিহর নদী (৩৫ কিমি), হরি-তেলিগাতি নদী (২০ কি.মি.), আপারভদ্রা নদী (১৮.৫ কি.মি.), টেকা নদী (৭ কি.মি.) ও শ্রী নদী (১ কি.মি.)সহ মোট ৫টি নদীর ৮১.৫ কিমি পুনঃখনন করার অনুমোদন দেয়া হয়। শুক্রবার থেকে ভবদহের ২১ ভেল্ট থেকে এই প্রকল্পের শুরু করবে সেনাবাহিনী।
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানান, ‘জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম প্রকল্প গণআন্দোলনে গৃহীত হলেও বিগত সরকার ২০১২ সালে ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার’ অজুহাতে বাতিল করে দেয়। এখন এই জনপদের মণিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগর শুধু নয়, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হয়েছে খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর শহর পর্যন্ত। নদী খনন, টিআরএম চালু, স্লুইসগেট খোলা, আমডাঙ্গা খাল খনন করা এই চারটি দাবি ছিলো। ইতোমধ্যে এই চারটি দাবি মেনে নিয়েছে পানি সম্পদ উপদেষ্টা। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। স্লুইসগেটের ২১ ভেল্টের ১২ টা খুলে দিয়েছে। প্রবল বেগে পানি নিস্কাশন হচ্ছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নদী খননের কাজ শুরু হচ্ছে। এতে আমরা আশার আলো দেখছি। তবে খননের সাথে টিআরএম চালু না হলে খনন প্রকল্প ব্যর্থ হবে। আমরা আশা করছি, উজানে নদী সংযোগ ও টিআরএম বাস্তবায়ন হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভবদহের জলাবদ্ধতার অবসান হবে।’
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটি আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, ‘আগে ভবদহ সংকট নিরসনে আশ্বাস দিলেও কাজ হয়নি। এ কারণে এলাকার বেশিরভাগ লোকজনই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তবে, এবার যেহেতু সেনাবাহিনীর অধীনে বাস্তবায়ন হবে, এই কারণে একটু আশার আলো দেখছেন তারা।’
পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, ‘শুক্রবার থেকে ভবদহ এলাকায় নদী পুনঃখনের কাজ শুরু হচ্ছে। টেকা হরিহর নদীর কাজ শুরু হলে ভবদহর দুর্ভোগ লাঘব হবে। খননের পর পলি অপসারণের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া আমডাঙ্গা খাল খননের জমি অধিগ্রহণ ছাড়াও বেঁড়িবাধ নির্মাণ কাজ চলমান। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি লাঘব হবে।’