মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু, কেশবপুর
আজ ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহানায়ক অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মহাকবি মাইকেল মধূসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ দিনব্যাপি মধুমেলা। যশোরের কেশবপুরের কপোতাক্ষ পাড়ের তীর্থভূীম সাগরদাঁড়িতে এ আয়োজনকে ঘিরে মধুভক্তদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
মধুমেলা ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৭ জানুয়ারি শেষ হবে এ মধুমেলা। প্রতিবারের ন্যায় এবারও মধুমেলার মাঠ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় মেলার মাঠ ইজারা দেয়া হয়েছে। মহাকবির জন্মদিন ২৫ জানুয়ারি হলেও ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষার কারনে ১৯ জানুয়ারি থেকে মেলা শুরু করতে হচ্ছে আয়োজক কমিটিকে। সাগরদাঁড়িতে মধু মেলাকে ঘিরে মেলার মাঠে সেজেছে বর্ণালী সাজে। আজ বিকেল ৫টায় জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি ও যশোর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদারের সভাপতিত্বে ও মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তুহিন হোসেনের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে এ মধুমেলা ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে মেলা উদ্বোধন করবেন ও প্রধান অতিথি হিসেবে মধুমঞ্চে বক্তব্য রাখবেন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস’র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার অধ্যাপক প্রফেসার ডক্টর সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখবেন, যশোর -১(শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন, যশোর -২ (ঝিকরগাছা) আসনের সংসদ সদস্য ডা. তৌহিদুজ্জামান, যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক বাবুল, যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য এসএম ইয়াকুব আলী, যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বিপিএম (বার) পিপিএম, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি
শহিদুল ইসলাম মিলন, যশোর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান যুদ্ধহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব কাজী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
মধুমেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন থেকেই প্রতিদিনই বিকেল ৩টা থেকে মধুমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। মধুসূদনের সৃষ্টি, সাহিত্য ও কর্মজীবনের উপর বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, দেশের খ্যাতিনামা কবি,সাহিত্যিক, প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিগন, সাংবাদিকবৃন্দ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। আলোচনা সভা শেষে একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভিন্ন দলগত সংগীতানুষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের খ্যাতিমান কণ্ঠ শিল্পীরা এখানে সংগীত পরিবেশন করবেন। প্রতিবারের ন্যায় মেলায় আগতদের মাঝে মেলা আকর্ষণীয় করে তুলতে মেলার উন্মুক্ত মঞ্চে যাত্রা, সার্কাস , ইজ্ঞিন ট্রেন, মৃত্যুকুপ, নাগোরদোলা ব্যবস্হা রয়েছে। এছাড়া মেলার মাঠে বসেছে নানা ধরনের আকর্ষনীয় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এবার মধু জন্মবার্ষিকী ও মধুমেলা অশ্লীলতামুক্ত হবে। মধুমেলার মাঠে অনুপ্রাণিত হবেন লাখো মধুভক্তরা। এদিকে বৃটিশ ভারতের প্রথম জেলা যশোরের কেশবপুরে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ধন্য সাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি চলে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। প্রতিবারের ন্যায় সরকারি টেণ্ডারের মাধ্যমে মেলার ইজারা দিয়েছেন আয়োজক কর্তপক্ষ। আয়োজক কর্তৃপক্ষ কোন প্রকার অপসংস্কৃতি চলতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মেলায় সব কিছু শালীনতার মধ্য দিয়ে উপসাপন করার জন্য কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকবে।
এদিকে ২৭ জানুয়ারি মধুমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে গুণী ব্যক্তিদের হাতে মধুসূদন দত্ত স্বর্ণপদক-২০২৪ তুলে দেয়া হবে। ’৮০ দশকে মধু কবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ির ‘পৈত্রিক বসতবাড়ি’ প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পরে কিছুটা ঘষামাজা করে পুরাতন জীর্ণশীর্ণ ভগ্নদশা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে কবির জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলা উদ্বোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাগরদাঁড়িতে পর্যটন কেন্দ্র ও মধুপল্লী গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যার প্রেক্ষিতে পর্যটনের একটি রেস্তোরাঁসহ কেন্দ্র ও মধুপল্লী নির্মাণ করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, প্রাণের কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্বর্গীয় জমিদার পিতা রাজনারায়ন দত্ত আর মাতা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বাঙ্গালীর প্রিয় কবি এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হন। প্রাকৃতিক অপূর্ব লীলাভূমি, পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, শষ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ সাগরদাঁড়ি গ্রাম আর বাড়ির পাশে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের সাথে মিলেমিশে তার সুধা পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে পরিনত যুবক হয়ে উঠেন। ‘কপোতাক্ষ নদ আর মধুসূদন’ দু’জনার মধ্যে গড়ে উঠে ভালবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। মধুকবি ১৮২৪ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে আজকের এই মৃত প্রায় কপোতাক্ষ নদ কাকের কালো চোখের মত স্বচ্ছ জলে কানায় কানায় পূর্ণ আর হরদম জোঁয়ার ভাটায় ছিল পূর্ণযৌবনা। নদের প্রশসস্ত বুক চিরে ভেসে যেত পাল তোলা সারি সারি নৌকার বহর আর মাঝির কন্ঠে শোনা যেত হরেক রকম প্রাণ উজাড় করা ভাটিয়ালী ও মুর্শিদি গান। শিশু মধুসূদন এ সব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত। স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের অবিশ্রান- ধারায় বয়ে চলা জলকে মায়ের দুধের সাথে তুলনা করে কবি তাই রচনা করলেন সেই বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’। তিনি লিখলেন- ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে’। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু গাঁয়ের পাঠশালায় তিনি বেশি দিন শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। আইনজীবী পিতা রাজনারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে ইংরেজী ভাষার প্রতি দুর্বল হয়ে পাড়ি জমান পশ্চিমা দেশ ফ্রান্সে। অবস্থান করেন ভার্সাই নগরীতে। বিদেশি ভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি এখানে বসেই তিনি রচনা করেন বাংলায় সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। সেখানে চলাফেরার একপর্যায়ে মধুসূদন পর্যায়ক্রমে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে ভয়ংকরভাবে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ফিরে আসেন আবারো কলকাতায়। এসময় তার পাশে ২য় স্ত্রী ফরাসি নাগরিক হেনরিয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার একটি হাসপাতালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পেছনে ফেলে রেখে যান একগুচ্ছ মনোকষ্ট আর অভিমান। মহাকবির মৃত্যুর পর ১৮৯০ সালে মহাকবির ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারি বসু সাগরদাঁড়িতে প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন। সেই থেকে শুরু হয় মধু জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলার।
কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জহিরুল আলম বলেন, অতীতের ন্যায় আগামী ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে মধুমেলা।এ মেলাকে নিয়ে কোন বির্তকের সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। যে কোন উপায়ে মেলার সুশৃংঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন বদ্ধ পরিকর। মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তুহিন হোসেন বলেন,১৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ থেকে শুরু হবে মধুমেলা।মেলায় মধুভক্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ও পাশাপাশি ডিবি, জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাথে প্রয়োজন মতো সাদা পোশাকে পুলিশ ও র্যাব-৬ বলবৎ থাকবে। এছাড়া মাঠে একাধিক নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ভাবে শতাধিক যুবকদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেচ্ছাসেবক বাহিনী।