বিল্লাল বিন কাশেম
আজ বিশ্ব মা দিবস। মা দিবসে আমি লিখি অনেকটা নিয়মিতই। গত বছরও মা দিবসে আমার লেখা ছিল। তখনও আম্মা জীবিত ছিলেন। আজ যখন এ লেখা লিখছি তখন মাহীন আমি ও আমরা। মিসেস গুলশান আরা বেগম (লিলি) (জম্ম: ১ ডিসেম্বর ১৯৬২; মৃত্যু: ১২ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.) ব্যক্তিগত দু:খবোধ থেকেই আমার এ লেখা। আমদের যে পরিবার, তা মাকে ঘিরেই আবর্তিত। আমরা পাঁচ ভাই-বোন। যেকোন শুভ-অসুভ কাজ আমরা মাকে ছাড়া করতে পারি না। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমরা মনে হয় তাকে ছাড়া চলতে শিখতে শুরু করেছি। আম¥াকে ছাড়াই এবারের একুশে বই মেলায় আমার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আম্মা মারা যাওয়ার পর আমার ছোট ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম খুব অসুস্থ। আম্মার স্মরণে খুব কান্নাটি করে। প্রতিদিন সে আম্মা যে রুমে থাকতেন সে রুমে অফিস থেকে এসে নামাজ পড়ে একাকী মোনাজাত করে।
মায়ের সাথে তার যে আত্মিক বন্ধন তা প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছে। আম্মার মৃত্যুর আগে আমিও চরম অসুস্থতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি হলে আমি আম্মার শয্যা পাশে গিয়েছি নামে মাত্র। তার কোন সেবা শুশ্রম্নষা করতে পারিনি।
আম্মাকে ছাড়া আমরা কোন সুন্দর মুহুর্ত চিন্তা করতে পারি না। অথচ আমরা তাকে ছাড়াই দিব্যি আছি।
কিডনি, ডায়বেটিস ও নানা রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ রোগের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তিনি পরাজিত হওয়ার মানুষ ছিলেন না। আম্মার জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে লিখতাম। উনাকে সেগুলো পড়ে শোনাতাম বা উনি নিজেই পড়ে হাসতেন।
কতো শত অভিমান, আনন্দ আর হাসি গানে আমরা দিন পার করেছি। আব্বা যখন ১৯৯০ সালে মারা যান আমরা ভাই—বোনর তখন খুব ছোট। রাজধানী ঢাকার জীবন ছেড়ে আমাদের জায়গা হয় জীবন ঈশ^রের এক অপরিসীম দয়া। জীবন—মৃত্যু যে কতো কাছাকাছি তা আমরা দেখি। আমাদের মায়ের মৃত্যু আমাদের সকলকে এই ভাবনা মনকে নাড়িয়েছে। মাঝে মােঝে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই এখন আল্লাহর একান্ত কৃপা। আমাদের আনন্দ বেদনা সব সাঙ্গ হবে যখন আমরা শেষ হয়ে যাবো।
কবির ভাষায় বলতে হয়,
‘প্রথমো যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে
কেঁদেছিলে একা তুমি, হেসেছিলো সবে
এমনো জীবন তুমি করিবে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ ‘মা’
দুই.
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর শ্রেষ্ঠ লাইন ‘হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ।’ মা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ। কি যাদুময় শব্দ ‘মা।’ রক্ত শুষে নিরাপদে ধীরে ধীরে মায়ের গর্ভদেশে সন্তান বড় হয়।প্রতিটি মা সন্তানদের ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করে অসহনীয় যন্ত্রণা সুখ হিসেবে হাসি মুখে সহ্য করেন। জগতের আলো দেখানোর পরও তিল তিল করে মা-ই তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে একটু একটু করে বড় করে আগামীর সম্ভাবনাময় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় ‘বিশ্ব মা দিবস’। যদিও মা’কে ভালোবাসতে কোনো নির্দিষ্ট দিন লাগে না। তবুও সমস্ত ব্যস্ততাকে ছুটি জানিয়ে মায়ের জন্য একটি দিন বিশেষ করা যায় ই। মায়ের কাছে সব দুঃখ, কষ্ট, হাসি, গল্প কথা সবই কতো সহজে আমরা বলতে পারি। কারণ মা ই আমাদের জন্য আপনার চেয়েও আপন। সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান অপরিসীম। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও অন্তিম ছোঁয়া অসম্ভব। মায়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিখ্যাত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বলেছেন। সমস্ত ধর্মেই মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে। মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য মায়ের পায়ের নিচেই রয়েছে তোমাদের জান্নাত।’ অর্থ সম্পদের হিসাবে আমরা ধনী গরিবের হিসাব নির্ধারণ করি। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আসল ধনী বলেছেন তাকে, যার মা আছে সে কখনই গরীব নয়। আমাদের প্রিয় মানুষেরা স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই আমাদেরকে ছেড়ে যান। কারো অপছন্দের সংজ্ঞায় একবার সংজ্ঞায়িত হলেই ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হয় কিন্তু সন্তান হাজার অন্যায় করলেও মা ক্ষমা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক লুসিয়া মে অরকটের ভাষায়, ‘মা সব কিছু ক্ষমা করে দেন। পৃথিবীর সবাই ছেড়ে গেলেও মা কখনো সন্তানকে ছেড়ে যান না।’
চারপাশে হাজার মানুষ থাকে। হাজার ঘটনাপ্রবাহ থাকে।বুদ্ধি জ্ঞান হবার তা আমরা অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু মায়ের সঙ্গ আমরা পৃথিবীতে আসার আগেই পায়। তাই মা ই আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ‘আমি যা হয়েছি বা ভবিষ্যতে যা হতে চাই তার সব কিছুর জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন। নারীর জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা হয় মা হবার স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে। কি অদ্ভুত সুন্দর একটা বিষয় যে একটা মায়ের থেকে আরেকটা নতুন মানুষ পৃথিবীতে আসছে। দারুণ ব্যাপার! অন্য কোনো কিছুতেই ভালোবাসার সুন্দর পরিমাপ সম্ভব হয় না যতটা অনুভব করা যায় মা হবার ফলে। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ভাষায়, ‘সব ভালোবাসার শুরু এবং শেষ হচ্ছে মার্তৃত্বে’। মায়ের বিশালতা হলো সুবিশাল প্রকৃতির মতো। উদারতায় মায়ের মন প্রাণ সুউচ্চ। সন্তানের সাফল্যে মায়ের প্রশংসা তৃপ্তির অনুভূতি যোগায়। আমেরিকান চিকিৎসক ও দার্শনিক ডা. দেবীদাস মৃধা বলেন,’ মা হচ্ছেন প্রকৃতির মতো। যেকোন পরিস্থিতিতে তিনি তার সন্তানের প্রশংসা করেন’।
একজন আদর্শ মায়ের ক্ষমতা অনেক বেশি। তিনি সন্তানকে সঠিক দিক নির্দেশনায় সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা পোষণ করেন। মায়ের পেটের এই সন্তান ই পৃথিবী শাসন করে। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বেনোপার্ট বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, তোমাদের একটা সভ্য, শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’
প্রকৃতির অন্য প্রাণি কিংবা মানুষ সবার ক্ষেত্রেই এটি সত্য বাণী যে সন্তানের জীবন এবং সেই জীবনের সমৃদ্ধির জন্য মা আসলেই পুরোটা দিয়ে নি:স্বার্থভাবে করেন। সন্তানের জন্য মা নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেন। সন্তানের জন্য উদারতায় সুউচ্চ এক প্রাণি হলো মাকড়সা। ডিম ফুটে মাকড়সার বাচ্চা হয়। বাচ্চা না হওয়া অবধি সেই ডিম নিজের দেহে বহন করে মা মাকড়সা। বাচ্চা হবার পর তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাবারের প্রয়োজন হয়। মা মাকড়সা তখন নিজের শরীর বিলিয়ে দেয়। খাবারের জ্বালা মেটাতে বাচ্চা মাকড়সারা মা মাকড়সার দেহকে ঠুকরে ঠুকরে খেতে থাকে। সমস্ত কষ্ট আর যন্ত্রণা মা নীরবে সয়ে যায়। একটু একটু করে খেতে খেতে মা মাকড়সার পুরো দেহখানির গন্তব্য হয় তার সন্তানদের পেটের মধ্যে। বিশাল আত্মত্যাগের কারণে মাকড়সা ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে পরিগণিত।
তিন.
নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘ এরাব সব ধ মড়ড়ফ সড়ঃযবৎ ও রিষষ মরাব ুড়ঁ ধ মড়ড়ফ হধঃরড়হ.’ আমাকে একটি ভাল মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভাল জাতি দেবো। একজন মা-ই পারে তাঁর সন্তানদের আদর্শবান করে গড়ে তুলতে। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় সন্তানদের বাবা হয়তো থাকে জন্মদাতা হিসেবেই। সন্তানের লালন পালন, পড়াশোনা ও সার্বিক খোঁজ খবর মাকে-ই নিতে হয়। সন্তানের গতিপথ ও নব-নব সবই শেখে মায়ের কাছ থেকে। খুব ছোট বেলায় আমার মনে আছে যে আমি ভাবতাম আমার মা-ই বিশ্বের সব চাইতে জ্ঞানী মানুষ। অবশ্য বড় বেলায় এখনো আমার ভাবনা একই রকম রয়েছে। আমাদের সব ভাই-বোনের আজকের যে অর্জন সবই তাঁর কারণেই।
আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলেন সংসার বৈরাগী মানুষ। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মকালীন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের করাচী থেকে দেশ মাতৃকার ক্রান্তিলগ্নে দেশে এসে সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং স্থানীয়দের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। আমার ফুপাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার মোহাসীন ভাই এর কাছ থেকে শুনি বাবার গল্প। কিভাবে দেশে পালিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে আসছিলেন আর একজন সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে কি করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেন। আমার বাবা বেঁচে থাকালীন সময়ে কখনো দেখিনি কারো সাথে বীরত্ব দেখাতে। সংসার বৈরগ্যের কারণে যতোদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আমাদের নিয়ে তাঁর ভাবনা ছিলোনা বল্লেই চলে। আমার বাবার বাড়ী নারায়ণগঞ্জ এর সোনারগাঁও এর কাজিরগাঁও গ্রামে। ১৯৯০ সালে আমার বাবা মোঃ আবুল কাশেম মৃত্যুবরণ করলে আমার মা আমাদের সব ভাই-বোন কে নিয়ে যশোরের কেশবপুর উপজেলার মঙ্গলকোট গ্রামে নিয়ে আসেন। কেশবপুর উপজেলা শহরেও আমার নানার বাড়ী আছে। তবে তিনি সেখানে আমাদের রাখেননি যে আমরা বাজারের ছেলেদের সাথে মিশে বখে যাবো।
রাজধানী ঢাকা থেকে মঙ্গলকোট গ্রামে এসে আমার মা অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়লেও আমাদেরকে কখনোই বুঝতে দেননি। প্রতিদিনই তিনি কাঁদতেন আমাদের অগোচরে। সেই সময় আমার মাকে আমি দেখেছি একদিকে তিন প্রচন্ড কড়া একজন মা, একজন সফল মালিক ও অভিভাবক। আমরা যে বাবাকে হারিয়ছি কখনো বুঝতে দেননি। বাবা থাকতেও আমরা যে আদর ভালবাসা পাইনি আম্মা তার সবটাই দিয়েছেন। বাবার পেনশন রেশন ইত্যাদির জন্য আমার বড় ভাইটাকে ও আমাকে নিয়ে যেতেন ঢাকাতে। আমার মায়ের খালু এক সময়ে যশোর-৬ এর সাংসদ গাজী এরশাদ আলী নানার মাধ্যমে একটি মালবাহী ট্রাক কেনা হয়েছিলো যা ট্রাক ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেয়েছিলেন তিনি। আমার আম্মা প্রায় প্রতিদিনই কেশবপুরে নানার বাসায় যেতেন টাকা পয়সার হিসাব করতে। ছোট বেলায় আমার কখনো মনে পড়ে না আমাদের ভাই-বোন কাওকে তিনি টাকা আনতে পাঠিয়েছেন। তখন আমার নানার বাড়ীর গ্রামে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হতো। সেগুলো আমাদের নানীর ভাগরাদার ছিলো তাদের দিয়েই বিক্রি করাতেন। পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে এ কারণে কখনো আমাকে বা অন্য ভাইদের বাজারে পাঠাতেন না। তবে আমার ছোট ভাইটা ভাল বাজার করতে পারতো বলে সে মাঝে মাঝে বাজার করতো বিকেলে। আমাদের সন্ধ্যার পরে কখনো বাড়ীর বাইরে যেতে দিতেন না। আজ আমরা যখন আমাদের সেসব দিনের কথা ভাবি মা অনকটাই আপ্লুত হয়ে পড়েন! গ্রামে আসার পর আমাকে গ্রামের বাড়ীর পাশে একটা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন আমার ছোট ইলিয়াস বিন কাশেম রাসেলকেও। আমার ছোট বোন ফারহানা তখন খুব ছোট স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। প্রতিদিনই নিজে আমাদের পড়াতেন এবং কড়া শাসনের মধ্যে জীবন চলতে লাগলো। আমি সে বছর গ্রামের ওই প্রাইমারীর মধ্যে মাত্র তিন মাস পরাশোনা করে রেকর্ড সংখ্যক মার্কস পেয়ে স্কুল ফার্স্ট হই। ক্লাস থ্রী থেকে সরাসরি ক্লাস ফাইভে। আমরা তিন ভাই-বোন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়েছি।
আমাদের ৫ ভাই-বোনের মধ্যে চারজনই সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। আমার বড় ভাই মুহাম্মদ বিন কাশেম জুয়েল রাজধানীতে ঠিকাদারী করেন করেন। বড় বোন ছামিয়া খাতুন গরুর ফার্ম গড়ে তুলেছন। ছোট ভাই ভাই ইলিয়াস বিন কাশেম স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা টেলিভিশনে কাজ করছে। ছোট বোন ফারহানা আফরোজ ঢাকা ব্যাংক এ কর্মরত। আজ আমরা যে যেখানেই আছি সব কিছুর কৃতিত্ব আমার মায়ের-ই। আজ আম্মা নেই। তারপরও মরন হয় সব কিছু তার ইশারায় চলে। মা-ই আমাদের পৃথিবী। বিশ্ব নারী দিবসে এমন একজন মহিয়সী মাকে জানাই শ্রোদ্ধা, ভালাবাসা, সালাম।