বাংলার ভোর প্রতিবেদক
পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন যে দুজন নেত্রী, তাদের একজন চিরবিদায় নিলেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে আন্দোলনে আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি। চার দশকের বেশি সময় তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিন দফায় দশ বছরের বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে করেছেন দেশ পরিচালনা। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী নেত্রী।
তিনি বিপদে-দুর্যোগে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। আর শেষ জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন জাতির ‘ঐক্যের প্রতীক’। আপোসহীন এই সংগ্রামী মহীরুহের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে মঙ্গলবার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতির শীর্ষে যাওয়ার এই নেত্রীর প্রয়াণ নিয়ে যা বললেন যশোরের রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা-
জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘একজন গৃহিণী থেকে রাজপথে এসেছিলেন। তিনি দীর্ঘপথ স্বৈরাচার আন্দোলন করেছিলেন। গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এরপর গণতান্ত্রিক ধারা চালু হলেও ফ্যাসিস আওয়ামী লীগ সেটি বাধাগ্রস্ত করে। সেখানেও আন্দোলন সংগ্রামে খালেদা জিয়ার ভূমিকা রেখেছিলেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পরে খালেদা জিয়া আপসহীন রাজনীতিক ছিলেন। অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি খালেদা জিয়া। সেই কারণে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত ১৭ বছর বিএনপির নেতাকর্মীরা যখন কারাগারে ছিলো, তখন খালেদা জিয়ার কাছে অনুপ্রেরণীত হতাম। নিজেরা ভাবতাম, একজন বয়স্ক নেত্রী বাংলাদেশের লড়াইয়ে জন্য কারাগারে অন্তরীন হয়েছে। সেই কারণে আমাদের কারাগারে যাওয়া খালদা জিয়ার অনুপ্রেরণা ছিলো।
জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম রসূল বলেন, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য খালেদা জিয়ার ত্যাগ, ভূমিকার কারণে তিনি আপোসহীন নেত্রী। তিনি ভারতীয় আধিপত্যের কাছে কখনো মাথানত করেননি। তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীব লড়াই সংগ্রাম করেছেন। জাতি আজ একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী নেত্রীকে হারাল। ঐক্যবদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনে বেগম খালেদা জিয়ার অগ্রণী ভূমিকা সমগ্র দেশবাসী আজীবন স্মরণ রাখবে শ্রদ্ধার সাথে। তার মৃত্যুতে আমরা মর্মাহিত।
টিআইবি যশোরের সভাপতি পাভেল চৌধুরি বলেন, খালেদা জিয়ার চলে যাওয়া আক্ষরিক অর্থে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার রাজনীতি বিএনপিতে অনেক আগেই গৌণ হয়েছিলো তার অসুস্থতার কারণে। গত স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে তার দীর্ঘ ভূমিকা ছিলো, কিন্তু এই মৃত্যুতে বিএনপিতে প্রভাব পড়বে না। তবে খালেদা জিয়ার সাফল্য হলো তার নেতৃত্বে বিএনপি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল। তার অনুপস্থিতিতে রাজনীতিতে শূণ্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়; সেটি নিয়ে তিনি পরিকল্পনা রেখেছেন। তার ছেলের রাজনীতিতে প্রবেশ থাকাতে বিএনপির রাজনীতিতে শূণ্যতা সৃষ্টি হবে না।
যশোর প্রেস ক্লাব যশোরের সাধারণ সম্পাদক বলেন, খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারর্সন রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেও তার নেতৃত্ব প্রজ্ঞা, ত্যাগ অবদান দলীয় পরিসরকে ছাড়িয়ে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের কল্যাণে হৃদয়ে অবস্থান করেছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ পুনঃগঠনে তার অবদান অনস্বীকার্য। এমন নেত্রীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি। পাশাপাশি বর্তমানে যে সংকট চলছে, নতুন বাংলাদেশ উত্তরণের যে সংগ্রাম পথচলা বাধাগ্রস্ত হবে বলেও আমি মনে করছি। তার শূণ্যতা পূরণ হওয়ার মতো না।
গণ অধিকার পরিষদের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আশিক ইকবাল বলেন, ‘খালেদা জিয়া একজন আপোষীন দেশনেত্রী। গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি কখনো আপোষ করেননি। নিশ্চয়ই তিনি এদেশের গণতান্ত্রিকামী মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরদিন থেকে যাবেন। তার এই মৃত্যু দেশ ও জাতির জন্য মহাশূন্যতা সৃষ্টি হবে। তিনি এমন মুহূর্তে বিদায় নিলেন যখন দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরতে শুরু করেছে। তিনি গণতন্ত্রের জন্য আপোষহীন ভাবে কাজ করেছেন। খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য টেনে ধরে তিনি বলেন, আমি দেশের বাহিরে কোথাও যাবো না! দেশের বাহিরে আমার কোন ঠিকানা নাই! তাঁর এই অমিয় বানী আমাদেরকে দেশপ্রেমের মহৎ শিক্ষা দেয়।
যশোর-৩ (সদর) আসনে সিপিবি মনোনীত প্রার্থী ও জুলাই যোদ্ধা রাশেদ খান বলেন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ‘আপোষহীন নেত্রী’ তকমা পেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। স্বৈরাচারী সামরিক শাসন, এবং হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিপরীতে বেগম জিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে! তবে, যে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে তিনি জোট গঠন করেছিলেন, আজ তার মৃত্যুর দিনটাতেও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করে তাকে অসম্মান করছে তার এক সময়ের মিত্ররা। একথা সত্য যে ২০০১-২০০৫ নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে প্রশাসনের দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতে শুরু করে বেগম জিয়ার শাসনামলে। র্যাব গঠনের মাধ্যমে ভিন্নমত দমনে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের শুরুটাও সে সময়েই, এমনকি পর পর তিন বছর দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পৌছে যায় শীর্ষে! বিএনপি ও তার জোট সরকারের হাজারটা যৌক্তিক সমালোচনা করা যায়, কিন্তু যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি সমাহিত হবেন, সেটা আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রাপ্য!
