মানবসভ্যতা আজ প্রযুক্তি, জ্ঞান ও উন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু তবুও বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংসের আগুন এখনো জ্বলছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সেই আগুনেরই এক নির্মম দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রতিদিনই মানুষ হারাচ্ছে জীবন, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ। ভয়াবহ বিষয় হলো, এই যুদ্ধে এখন যুক্ত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের তরুণেরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পাড়ি জমাচ্ছে রাশিয়ায়, অনেকেই আবার প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে নাম লেখাচ্ছে সেনাবাহিনীতে। প্রশ্ন জাগে, কেন? আর কতদিন আমাদের সন্তানরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরদেশে মৃত্যুর মুখে ছুটবে?
সম্প্রতি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বহু বাংলাদেশি তরুণ দালালচক্রের প্রলোভনে পড়ে রাশিয়া যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভাবছেন সেখানে চাকরি পাবেন, কেউ আবার বিশ্বাস করছেন, রাশিয়ায় কাজ করলে নাগরিকত্ব বা মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভয়াবহ। অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে, কেউ নিখোঁজ, কেউ ফিরে আসছেন মৃতদেহ হয়ে। এইসব ঘটনার পেছনে রয়েছে এক গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট, যেখানে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও হতাশা তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর ফাঁদে।
এই পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি এক ভয়ংকর জাতীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র যখন তার তরুণ প্রজন্মকে নিরাপদ জীবিকা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে ব্যর্থ হয়, তখনই দালালচক্র, মিথ্যা প্রলোভন ও অবৈধ অভিবাসনের পথ খুলে যায়। একদিকে আমরা তরুণদের “দেশের ভবিষ্যৎ” বলে আখ্যা দিই, অন্যদিকে সেই ভবিষ্যৎই যখন রাশিয়ার যুদ্ধের কামানের গোলায় ঝলসে যায়—তখন আমাদের নীরবতা অপরাধেরই সমান।
সরকারের দায়িত্ব শুধু নিষেধাজ্ঞা বা শোকপ্রকাশ নয়, এর চেয়ে বড় দায়িত্ব হলো প্রতিরোধ ও বিকল্প পথ তৈরি করা। বিদেশে কর্মসংস্থান নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি প্রণয়ন, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, এবং দেশে যুব উন্নয়ন প্রকল্পকে বাস্তবমুখী করা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে পরিবার ও সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে, অর্থের লোভে সন্তানের জীবন যেন এভাবে ঝুঁকির মুখে না পড়ে।
আজ আমাদের ভাবতে হবে, কয়েক লাখ টাকার আশায় যদি তরুণরা যুদ্ধের ময়দানে জীবন হারায়, তবে সেটা কেবল ব্যক্তিগত নয়,জাতিরও পরাজয়। একটি জাতির ভবিষ্যৎ তার তরুণ প্রজন্মের হাতে গড়ে ওঠে, আর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ দায়িত্ব।
আমাদের সন্তানরা যেন রাশিয়ার যুদ্ধ নয়, নিজেদের দেশের মাটিতে শান্তি, উন্নয়ন ও স্বপ্নের যুদ্ধ লড়ে—এটাই হোক আজকের আহ্বান।
প্রশ্ন রয়ে যায়, আর কতদিন আমাদের সন্তানরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেবে?

