বাংলার ভোর প্রতিবেদক
শামীম কবির। এক ডজন হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকায় কিলার শামীম নামেই বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের যশোর কিংবা ঝিনাইদহ জেলা নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা ও নদীয়া জেলায়ও তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাস হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে যশোর ও চৌগাছা থানার অন্তত ১৪টি মামলার আসামি তিনি। দুটি অস্ত্র মামলায় ২৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি তিনি। এছাড়া ঝিনাইদহ ও ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় একাধিক হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তিন দশক ধরে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার আশ্রয়ে কিলার শামীম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ওই নেতা কিলার শামীমকে ব্যাবহার করে আসছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কিলার শামীমকে এলাকায় দেখা যায়নি। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কিলার শামীম এলাকায় থাকে। অন্য সময় ভারত কিংবা দেশের অন্যত্র আত্মগোপনে চলে যান। তিনি যেখানেই থাকেন, সেখানে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। শামীম কবির ওরফে কিলার শামীম যশোরের চৌগাছা উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের মৃত সামছুল হকের ছেলে।
এ বিষয়ে চৌগাছা থানার ওসি ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, শামীম এলাকায় নেই। পুলিশ তার খোঁজখবর নিচ্ছে।
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে কিলার শামীমের সংশ্লিষ্টতা:
অভিযোগ আছে, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম হাবিবুর রহমানের আশ্রয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে শামীম কবির ওরফে কিলার শামীম। তিন দশক ধরে ওই নেতা শামীমকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আর শামীম ওই নেতার দাপট কাজে লাগিয়ে চালিয়ে গেছেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
২০১২ সালের ৮ জুলাই চৌগাছা উপজেলার গরীবপুর গ্রামের ৭ বছরের শিশু সৌরভ সাহাকে অপহরণ করে খুন করে কিলার শামীম। এরপর ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিংহঝুলি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভপতি জিল্লুর রহমান মিন্টুকে দুপুর আড়াইটার দিকে প্রকাশ্যে সামনে শর্টগান দিয়ে গুলি করে খুন করে কিলার শামীম। জিল্লুর রহমান মিন্টু চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক প্রার্থী হওয়ায় তাকে খুন করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিকে সরিয়ে দিতে কিলার শামীমকে ব্যবহার করেছেন চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি এসএম হাবিবুর রহমান। তার নির্দেশে জিল্লুর রহমান মিন্টুকে হত্যা করা হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ। এর আগে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাশাপোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুলকে গুলি করে ও বোম মেরে খুন করা হয়। তিনিও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তাকেও হত্যা করা হয়। তবে বাদী ওই সময় এসএম হাবিবুর রহমানকে আসামি করতে সাহস পাননি।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আলোচিত কিলার শামীম:
২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর পুলিশ পরিচয়ে এক কলেজ ছাত্রের বাড়ির দরজা ভেঙ্গে শর্টগান ঠেকিয়ে উঠিয়ে নিয়ে ব্যাপক মারপিট করে কিলার শামীম ও তার বাহিনী। ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুযারি হাতে শর্টগান ও কোমরে পিস্তল গুজে রাখা একটি ছবিসহ কিলার শামীমের দেহরক্ষী জাহাঙ্গীরপুরের সন্ত্রাসী মনিকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে কিলার শামীমের হাত থেকে নিজ স্ত্রী কন্যার ইজ্জত বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান কাঠ মিস্ত্রি আকতারুল। সে সময় আকতারুল জানিয়েছিল তার কথায় রাজি না হওয়ায় সেই শর্টগান দিয়ে তার বাড়ির ভিতর আকাশে গুলি ছুড়ে ভয় দেখিয়েছিল শামীম। এছাড়া গ্রামের হিন্দু পাড়ায় গৃহবধূদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো এই কিলার শামীম। তবে বেশিরভাগ ঘটনায় থানার ওসিরা তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে দ্বিধাবোধ করতেন এবং কেউ কেউ নিতেন না। ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয় কিলার শামীম। একই বছর ২৪ নভেম্বর রাতে মাতাল অবস্থায় নিজ গ্রামের আব্দুল নামে একজনকে শর্টগানের দিয়ে পিটাচ্ছিল কিলার শামীম। সেই সময় আব্দুলের চিৎকারে তারা ভাইসহ স্থানীয়রা এসে কিলার শামীমকে পিটিয়ে সেই শর্টগান কেড়ে নেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির খোসা ও একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করে। কিন্তু কি এক আশ্চর্য কারণে কিলার শামীমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। তবে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ও উদ্ধারকৃত আলামতের সেই ভিডিও এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্যমান। দীর্ঘদিন এই কিলার শামীম একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেও আজ পর্যন্ত কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শামীমের খালাত ভাই মনিরুল ইসলাম ঝিকরগাছা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা। সে তার ভায়ের আশ্রয়ে থাকে এবং গ্রামে আসা যাওয়া করে। চৌগাছায় অপকর্ম করেই আবার ঝিকরগাছায় চলে যায়। সেখানে হক সাহেব নামে এক যুবলীগ কর্মী সর্বদা কিলার শামীমের সহযোগি বলে জানা যায়। ৫ আগষ্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর কিলার শামীম ঝিকরগাছাতে অবস্থান করছিল বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ভারতে একাধিক হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড শামীম:
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ^াসী কিলার শামীম দল ক্ষমতায় না থাকলে ভারতে চলে যায়। তার নাগরিকত্বও আছে। ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকারের আমলে শামীম ভারতের বনগাঁয়ের গাড়াপোতার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলয়-সাত্তারের শেল্টারে ছিল। সেখানেই ২০০৩’র ঈদের দিন সকাল ১০টার দিকে নিমাই নামে একজনকে হত্যা করে কিলার শামীম ও তার সহযোগিরা। ২০০৪-২০০৫ সালে বনগাও কালপুরে একটি ও একই সালে হেলাঞ্চা বাজারে কংগ্রেসের স্থানীয় একজন নেতাকে শামীমের নেতৃত্বে খুন করা হয়। সেই ঘটনায় খুনিরা একটি মোটর সাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশি তদন্তে সেটি সন্ত্রাসী সাত্তারের ছেলে আক্তারের মোটরসাইকেল (পালসার) বলে জানা যায়। খুনিদের পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। ২০০৫ সালে নদিয়া জেলার গোপালনগর থানায় কুতুবকে খুন করে শামীম ও তার বাহিনী। ২০০৬ সালে শামীম গাড়াপোতার ক্লাস লাইনের মুসলিম শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কাকে অপহরণ করে। সে ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ জনতা মানববন্ধন ও মিছিল করলে শামীমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০৬ সালে হানেফ এবং ২০০৯ সালে মিরপুরের সাহাদত বাহিনীর মুক্তারের নেতৃত্বে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালির লাল বাহিনীর লাল ওরফে ওবায়দুর রহমানকে ভারতে খুন করে শামীম ওরফে কিলার শামীম ২০০৯ সালে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশে ফিরে আসে শামীম।
যেভাবে উত্থান কিলার শামীমের:
১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশের পরে চৌগাছা উপজেলার জামালতা গ্রামের আমির নামে বিএনপির এক কর্মীকে গাছি দা দিয়ে কোপ দেয় শামীম। পরে শামীমকে বাবা তাকে ১৯৯৫ সালে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেন। ৪-৫ মাস পরে শামীম দেশে ফিরে আসে সে। সন্ত্রাসী হিসেবে শামীম ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জেলখানায় যশোর সাতমাইল শ্যামনগরের মোখলেছুর রহমান নান্নু ওরফে কিলার নান্নুর সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৯৬’র আওয়ামী লীগের সময় যশোর জেলা, বারোবাজার, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ দক্ষিনাঞ্চলে সর্বহারা পাটির শরিফুল বাহিনী বেশ প্রভাব বিস্তার করে। ওই বাহিনীর হয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার কারনে নান্নু ওরফে মোখলেছুর রহমান নান্নুকে শরিফুল তার বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ঘোষনা করে। ১৯৯৭ সাল থেকে চৌগাছার কিলার শামীমের গ্রাম নান্নুর নিরাপদ আশ্রয় ছিল। চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি এসএম হাবিবুর রহমানের সর্বোচ্চ আস্থাভাজন হওয়ায় সেসময় পুলিশ ওই গ্রামের আশেপাশে ভিড়তো না। শামীম তার বন্ধু জাহাঙ্গীরপুরের নান্নু ও কিলার নান্নু ১৯৯৮ সালের ১৬ জুন পুলিশের হাতে চাকুসহ গ্রেফতার হয়। সেই মামলায় শামীমের তার ৭ বছর সাজা হয়। ১৯৯৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১/১২টার দিকে কিলার শামীম, নান্নুসহ সন্ত্রাসীরা মকবুল হোসেন নামে বিএনপির এক ইউপি সদস্যকে গুলি করে ও কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে হত্যা করে। পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মামলার চার্জশীট থেকে নিজের নাম বাদ দেয়। একই বছর ১১ এপ্রিল গভীর রাতে বেড়গোবিন্দপুরের বাঁওড়ের গার্ড সহিদুল ইসলামকে নৃশংসভাবে চাকু মেরে ও কুপিয়ে হত্যা করে কিলার শামীম ও তার বাহিনী। ২০০৪ সালে গরীবপুর গ্রামের বিএনপি কর্মী মান্নানকে ফুসলিয়ে ভারতে নিয়ে খুন করে কিলার শামীম।