বাংলার ভোর ডেস্ক
ইরানের দুটি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ও দক্ষিণাঞ্চলে পৃথক হামলা চালিয়েছে। যা অনেকটা অবাক করেছে ইসরায়েলকে। হামলার বিষয়টি স্বীকার করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে ইরানের একমুখী আক্রমণাত্মক ড্রোন সফলভাবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে বলা হয়, শনিবার ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তসংলগ্ন বেইত শেইন শহরে একটি ড্রোন আঘাত হানে। এতে একটি দুইতলা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। জরুরি উদ্ধারকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে বাড়িটির পাশে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, জানালা ও দরজা উড়ে গেছে। ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা মাগেন ডেভিড আডম (এমডিএ) জানিয়েছে, তারা ধ্বংসস্তূপের ভেতর তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। হতাহত কারও খোঁজ পায়নি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তথ্যমতে, ইরানের দ্বিতীয় ড্রোনটি ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি খোলা এলাকায় আঘাত হানে। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইরান যে বিপুলসংখ্যক ড্রোন ছুড়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই প্রতিহত করা হয় বলে দাবি ইসরায়েলি বাহিনীর।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ইরানের সর্বশেষ হামলায় অন্তত ছয়টি ড্রোন ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি ড্রোন আরাভা মরুভূমি ও গোলান মালভূমিসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছানোর আগেই ঠেকানো হয়।
ইসরায়েলের এক সামরিক কর্মকর্তার মতে, গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করার পর থেকে ইরান হামলার জন্য হাজারের বেশি ড্রোন পাঠায়। যা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই নিষ্ক্রিয় করা হয়।
সংঘাত বন্ধে মাখোঁর ফোনালাপ
ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধ করতে নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। এর অংশ হিসেবে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ফোনালাপ হয়েছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সর্বশেষ বক্তব্যে জানা গেছে, তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। মাখোঁ জানান, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা আরও দ্রুততর করতে তিনি (ইরানের প্রেসিডেন্ট) সম্মত হয়েছেন।
এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে মাখোঁ লেখেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলছি, ইরান কখনও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে পারবে না। এটি ইরানের দায়িত্ব যে, তারা তাদের কর্মসূচি যে শান্তিপূর্ণ, সেটা প্রমাণে সব রকম নিশ্চয়তা দেবে।’ তিনি আরও বলেন, তিনি নিশ্চিত, এই যুদ্ধ থেকে উত্তরণের পথ আছে এবং বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।
এই লক্ষ্যে ফ্রান্স ও ইউরোপীয় অংশীদারদের নেতৃত্বে ইরানের সঙ্গে চলমান আলোচনা ত্বরান্বিত করা হবে বলে উল্লেখ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাঁখো।
ইরানের অন্তত ৪০টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে: ইসরায়েল
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গত রাতে ইরান থেকে ছোড়া প্রায় ৪০টি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমায় পৌঁছানোর আগেই সেগুলো প্রতিহত করেছে। হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় নিখুঁত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বজায় রাখা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বিবৃতির বরাত দিয়ে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, গত রাতে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ছোড়া আনুমানিক ৪০টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে বিমানবাহিনী। এ নিয়ে অভিযানের শুরু থেকে মোট ৪৭০টিরও বেশি ড্রোন প্রতিহত করা হয়েছে, যার সফলতা প্রায় ৯৯ শতাংশ।
ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল
ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা জানিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট কোন এলাকায় হামলা চালানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এর কিছুক্ষণ পর খুজেস্তান প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্ফোরণে শব্দ শোনা যায় বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা। ইরানের স্থানীয় ইরান গণমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, খুজেস্তান প্রদেশের আহভাজ শহর এবং মহশাহর বন্দরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
ইরানের ইস্পাহানে সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে: ইসরায়েল
ইরানের ইস্পাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করেছে।
ইসরায়েল বলছে, ওই ছবি ও ভিডিওকে ইস্পাহানে পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হামলার প্রমাণ।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আবিচাই আদরায়ি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ছবি ও ভিডিওর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এটাই ইস্পাহানের সেই পারমাণবিক স্থাপনা, যেখানে ইউরেনিয়াম রূপান্তর করা হয়। এটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথের পরবর্তী ধাপ।’ ওই মুখপাত্র আরও জানান, ইসরায়েলের বিমানবাহিনী ওই কেন্দ্রীয় স্থাপনাসহ সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত ভবনগুলোতে হামলা চালিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত রয়েছে।
সংঘাতে মার্কিন সম্পৃক্ততা হবে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’: ইরান
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, আমাদের জনগণের ওপর যখন বোমা হামলা করা হচ্ছে তখন আমরা আলোচনায় যেতে পারি না। তিনি দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই আগ্রাসনে প্রথম দিন থেকেই যুক্ত আছে। যদিও এই দাবির পক্ষে তিনি কোনও প্রমাণ দেননি।
ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ‘খুবই বিপজ্জনক’ হবে বলে সতর্ক করেছেন আরাঘচি। যদিও ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের সাথে আলাপে, কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি থাকার কথা জানিয়েছেন।
অবশ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহের শুরুতে ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইরান যদি তার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে রাজি হয়, তাহলে তিনি হামলা থেকে বিরত থাকবেন বলেও জানিয়েছেন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খুঁজতে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে এমন কথিত অভিযোগ নিয়ে বছরের পর বছর উত্তেজনার পর ২০১৫ সালে, বিশ্বশক্তিগুলোর একটি পক্ষের সাথে নিজের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। আরাঘচি আরও বলেন, কূটনীতি অতীতেও কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও কাজ করতে পারে। তবে কূটনীতিতে ফিরে আসতে হলে আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।
এদিকে, ইসরায়েলে বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কৌশলে পরিবর্তন এনেছে ইরান। দেশটির সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা এই দাবি জানিয়ে বলেছেন, ইরান এখন আর আগের মতো বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে না। বরং আগের তুলনায় অধিক উন্নত ও নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অজ্ঞাত ওই কর্মকর্তা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ ফুরিয়ে আসছে বলে ইসরায়েল যে দাবি করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
গত কয়েক দিন ধরে ইসরায়েল বলে আসছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে থাকলেও তাদের চালানো বিমান হামলায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকারী যন্ত্রের অন্তত ৫০ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে। এর মাধ্যমে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
ইরানের সামরিক বাহিনী বর্তমানে আরও উন্নত প্রযুক্তির নিখুঁত নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলে হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন ইরানি ওই কর্মকর্তা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীও (আইডিএফ) ইরানের এই দাবির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েলের হোম ফ্রন্ট কমান্ড বলেছে, ইরান এমন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, যেগুলো ক্লাস্টার বোমা বহনে সক্ষম।
এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড বা বোমা নির্দিষ্ট উচ্চতায় (প্রায় ৭ কিলোমিটার) পৌঁছে অন্তত ২০টি বিস্ফোরক অংশে ভাগ হয়ে যায় এবং প্রায় ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
ইরানি ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছি এবং তা সহজেই মার্কিন থাড, প্যাট্রিয়ট, অ্যারো ৩, অ্যারো ২, ডেভিডস স্লিং ও আয়রন ডোমের সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে নির্ধারিত লক্ষ্যে আঘাত করেছে।’’ তবে তিনি সেই ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুর নাম প্রকাশ করেননি। তিনি বলেন, ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খুশি না হয়ে ইসরায়েলের নীরব এবং ইরানের নতুন শক্তির ভারসাম্যের সামনে কেবল দর্শকের ভূমিকায় থাকা উচিত। এদিকে, গত সপ্তাহে সংঘাতের শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ইরানে অন্তত ৪৩০ জন নিহত হয়েছেন বলে শনিবার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম নউর নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গত ১৩ জুন সংঘাতের শুরুর পর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৩০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ইসরায়েলি হামলায় আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ।
বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার নিহত: ইসরায়েল
ইসরায়েলের শুক্রবারের হামলায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইহুদি দেশটির সামরিক বাহিনী। তাদের ভাষ্য, নিহত আমিন পোর জোদাখি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর দ্বিতীয় ইউএভি (ড্রোন) ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন বা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ইসরায়েল আক্রমণ শুরু করার পর জোদাখি শীর্ষ পর্যায়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন।
আল জাজিরা লিখেছে, ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি এই সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যদিও সেগুলোর সামরিক প্রভাব সীমিত। কারণ বেশিরভাগই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। তবুও এগুলো শনাক্ত, অনুসরণ এবং ধ্বংস করতে অনেক সম্পদ ও জনবল ব্যবহার করতে হচ্ছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এ পর্যন্ত ২৫ জন নিহত ও শত শত মানুষ আহত হয়েছে।
অন্যদিকে ইরানি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় ৬৩৯ জন নিহত এবং ১৩০০ জনের বেশি আহত হয়েছে।