বাংলার ভোর প্রতিবেদক
বর্গাচাষি রাশেদ আলী (৭০)। আড়াই বিঘা জমি ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে বর্গা নিয়ে সবজি চাষ করেন। এখন তাঁর ক্ষেতে রয়েছে মিষ্টি কুমড়ো। এক ভ্যান মিষ্টি কুমড়ো নিয়ে কাকডাকা ভোরে মোকামে এসেছেন তিনি। মোকামে পাইকারের সমাগম কম। বেলা ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন। পাইকারী প্রতিকেজি মিষ্টি কুমড়ার দাম হেঁকেছেন সর্বোচ্চ ১২ টাকা। এত কম দামে বিক্রি করতে মনে সাই দিচ্ছে না রাশেদ আলীর। উপায় না পেয়ে একপর্যায়ে ১২ টাকা কেজিতেই মিষ্টি কুমড়ো বিক্রি করতে হলো তাঁকে। পাশেই পেঁয়াজ বিক্রি করছিলেন কৃষক তাপস কুমার ঘোষ। তাঁর এক ভ্যান পেঁয়াজ বিক্রি করবেন। পাইকারী প্রতি কেজির দাম ২৯ টাকার বেশি দিতে রাজি নয় ক্রেতা। তাপসের দাবি ত্রিশ টাকা কেজি। দরকষাকষির একপর্যায়ে ৩০টাকা কেজি দরেই বিক্রি করলেন তিনি। বিক্রি করে তাদের যেন মাথায় হাত। বিক্রিত টাকায় উৎপাদন খরচই উসুল হচ্ছে না। দায়দেনা কিভাবে পরিশোধ করবেন, সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। গত সোমবার সকালে দেশের বৃহত্তম সবজির মোকাম যশোরের বারিনগরের দৃশ্য এটি।
এক বুক ক্ষোভ নিয়ে সদর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের কৃষক রাশেদ আলী বললেন, ত্রিশ বছর ধরে চাষাবাদ করি। আমার নিজের জমি নেই। আড়াই বিঘা জমি (৩৩ শতকে বিঘা) বর্গা নিয়ে চাষ করি। প্রতি বিঘা জমির বর্গা বাবদ বছরে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কয়েক মাস আগে ক্ষেতে মুলো চাষ করেছিলাম। কিন্তু বর্ষার কারণে গাছ মারা গিয়েছিল। এক টাকারও মুলো বিক্রি করতে পারিনি। এরপর চাষ করেছি মিষ্টি কুমড়ো। ফলন মোটামুটি ভাল হয়েছে। কিন্তু দাম খুবই কম। গত হাটে ৮ টাকা কেজি বিক্রি করেছিলাম। আজ হাটে বিক্রি করলাম ১২টাকায়। এত কম দামে বিক্রি করলে আমাদের পিঠ বাঁচবে না। বাকিতে তেল, সার, কীটনাশক কিনেছি। দোকানদার ৮০ হাজার টাকা পাবে। সব কুমড়ো বিক্রি করেও দেনা শোধ হবে না। দোকানদার তো শুনবে না। গরু বেঁচে হলেও দেনা শোধ করতে হবে। তেল, সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বেড়েই যাচ্ছে। ফসল ফলাতে খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফসল বিক্রির পর অর্ধেক খরচও উঠছে না। চাষ ছাড়া উপায় নেই, তাই মার খেয়েও পড়ে আছি।’
আরেক চাষি সদর উপজেলার তীরেরহাট গ্রামের তাপস কুমার ঘোষ বলেন, এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছি। বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ এক লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের দাম পাচ্ছি ২৭ টাকা থেকে ৩০ টাকা কেজি। এতে খরচের অর্ধেকও উঠবে না। সারের দোকানদার তো দেনা মাফ করবে না। গরু-ছাগল বিক্রি করে হলেও শোধ করতে হবে দেনা। এভাবেই আমরা বছরের পর বছর মার খাচ্ছি। আমাদের দেখার কেউ নেই।’
কলমাপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, দুই বিঘা জমিতে ফুল কপি চাষ করেছি। প্রতি পিস চারা কিনেছিলাম আড়াই টাকা। সেই ফুলকপি এখন পাঁচ টাকা পিস বিক্রি করছি। চাষে বিঘা প্রতি ৪০-৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফুলকপি বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা আয় হবে কিনা সন্দেহ আছে। এভাবে মার খেলে আমরা বাঁচবো কিভাবে? শিমের চাষ করেও খরচের টাকা পাইনি।
সদর উপজেলার দৌলতদিহি গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন তরফদার জানান, তিন বিঘা জমিতে আলু, সাত বিঘা মূলা, এক বিঘা পটল, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও পাতা কপি চাষ করেছেন। এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে খরচ হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ হাজান টাকা। ইতোমধ্যে এক বিঘা জমির আলু তুলে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এক বিঘা জমির আলু বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকায়। লস হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এখনও ৬ বিঘা জমির আলু তুলতে বাকি রয়েছে। বর্তমান দামে আলু বিক্রি করলে, সাত বিঘা জমিতে লস হবে দুই লাখ টাকা। উৎপাদিত সবজি নির্দিষ্ট দামে সরকার ক্রয় কলে কৃষক বাঁচবে।
শুধু সবজি চাষি নয়, ধান চাষেও ন্যায্য দাম বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি এলাকার কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ইরি আবাদ (বোরো) শুরু হয়েছে। খরচ যে হারে বেড়েছে, তাতে ধান চাষে খরচ উঠবে না। তারপরও চাষ করছি খাওয়ার জন্য। তার হিসেবে, এক বিঘা (৩৩শতক) জমিতে ২০ থেকে ২২ মণ ধান উৎপাদন হয়। প্রতিমণ ধানের দাম এক হাজার টাকা হলে আয় সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা। জমি তৈরি, সার, কীটনশাক, রোপণ, পরিচর্যা, কাটা, ঘরে তোলা ও মাড়াই বাবদ খরচ দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা। বেশিরভাগ কৃষক স্থানীয় দোকানে ধার-দেনা করে ধান চাষ করেন। ফসল উঠার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয়। চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। আবার উপকরণের দাম বেড়েই যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, বাজারে সরবরাহ বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমে যায়। কৃষকদের বাজারের চাহিদা বিবেচনায় ফসল চাষাবাদে উৎসাহিত করি। একই ফসলের বেশি চাষ না করে, পরিমাণে অল্প হলেও নানা রকমের ফসল চাষে পরামর্শ দিই। বৈচিত্রময় ফসল চাষে কৃষকের লোকসানের শংকা কম থাকে। উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। যদিও সরকার সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যশোরে সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নেই। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। সরকার পাইলট প্রকল্পের আওতায় হিমাগার তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সাময়িক হিমাগারে সবজি সংরক্ষণের সুযোগ হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবে।