বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তিনি বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি এবং সাম্যের কবি। নজরুল কোন একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না এটা যেমন ঠিক তেমনি কাজী নজরুল ইসলামের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিলো বিশ্বজোড়া। সেই সময়কার সমাজ ও পরিবেশের ওপর ভর করে কবি নজরুল বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে কি কবিতা, গান, গজল, শ্যামাসঙ্গীত, হামদ, নাত থেকে শুরু করে সকল অঙ্গনে তার বিচরণ আমাদেরকে মুগ্ধ করে। কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রাচ্যসংঘ যশোর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, আপনি জীবনে কতগুলো বই পড়েছেন সেটা বিবেচনার বিষয় নয়, সেই বইগুলোর মধ্যে কোন বই আপনার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে কিনা সেটাই বিবেচ্য। যদি কোন লেখকের কোন একটি লেখা আপনার জীবনকে পাল্টে দিতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই লেখক আপনার জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। আপনি একজন লেখকের লেখা পড়ে সেই লেখকের সাথে কতটুকু সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারলেন সেটাই বিবেচ্য।
তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা অকপটে বলে দিতেন। তিনি স্পষ্টবাদী লেখক ছিলন। তিনি তাইতো সাহস করে বলতে পেরেছিলেন, ‘বলো বীর চির উন্নত মম শীর, আমি সেই দিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনীবে না’। কিংবা আমি ভণ্ড ভগবানের বুকে একে দিই পদচিহ্ন। আবার তিনি বললেন, গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয়, নহে কিছু মহিয়ান। তাইতো আমরা বলি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে তিনি বিদ্রোহী কবি, তিনি প্রেমের কবি, তিনি দ্রোহের কবি, তিনি সাম্যের কবি।
তিনি বলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ যা গানে বা কবিতায় বা উপন্যাসে উপমা আকারে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছেন, সেই কথা কাজী নজরুল ইসলাম সাহস করে প্রকাশ্যে সোজা সাপটা বলে দিয়েছেন। কারণ তার হারানোর কোন ভয় ছিলো না। আর বিশ্ব কবি হারানোর ভয়ে সর্বদা শঙ্কিত থাকতেন। তারা দুইজনই আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই দুই জনের মধ্যে আমরা কোন বিভেদ চাই না। এই দুই জনকে আমরা সমানভাবে চর্চার মাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে চাই। মনে রাখতে হবে এই দুই কবিই তাদের সময়কার সেরা। সময় বা প্রেক্ষিত একজন কবিকে তার রচনা তৈরিতে সাহায্য করে। সময়ের আবর্তে মানুষ নিজেকে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আর যারা সেটা করতে পারেন তারাই সৃষ্টির মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করেন। বেঁচে থাকেন তার সৃষ্টির মধ্যে।
প্রাচ্যসংঘ যশোরের সভাপতি কবি কাসেদুজ্জামান সেলিমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা, সঙ্গীত ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন যশোর জেলা পরিষদের সিইও আসাদুজ্জামান আসাদ, প্রেস ক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন ও প্রাচ্যসংঘ যশোরের প্রতিষ্ঠাতা লেখক, গবেষক, চিন্তক সাংবাদিক বেনজীন খান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন প্রাচ্যসংঘ যশোরের সাধারণ সম্পাদক খবির উদ্দিন সুইট। কবি কাজী নজরুলের জীবনী পাঠ করেন প্রাচ্যসংঘ যশোরের কার্যনির্বাহী কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক পারভীনা খাতুন।
আলোচনা পর্ব শেষে প্রাচ্য আকাদেমি ও প্রাচ্যসংঘ যশোরের শিল্পীবৃন্দের পরিবেশনায় কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা পরিবেশন করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জেলা পরিষদের সিইও আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের কবি, প্রেমের কবি ও দ্রোহের কবি। তার প্রতিটি লেখা আমাদের প্রেরণার উৎস। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন কাজী নজরুলের রচনা সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছিল, তেমনি ২৪ জুলাই আন্দোলনেও আমাদের ছাত্রজনতাকে নজরুলের গান ও কবিতা উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে। তাই বেশি বেশি করে আমাদের জাতীয় কবির রচনা সমগ্র চর্চা করতে হবে।
প্রেস ক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্ব স্ব অবস্থানে তাদের রচনায় অমর হয়ে আছেন। একজন বিশ্ব কবি আর একজন বিদ্রোহী কবি আমাদের জাতীয় কবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে যেভাবে রবীন্দ্র নাথকে চর্চা করা হয়, সেই ভাবে জাতীয় কবি নজরুলকে চর্চা করা হয়না। বিশেষ করে গত ১৫-১৬ বছর দেশে নজরুলের চর্চা ছিলনা বললেই চলে। তাই এখন সময় এসেছে বিশ্বকবির পাশাপাশি বিদ্রোহী কবি ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সমানভাবে চর্চা করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে নজরুলের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে। বেশি বেশি করে নজরুলের চর্চা করতে হবে। এবং নজরুলের রচনার সারবস্তু আমাদের হৃদয়ঙ্গম করতে হবে।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বেনজীন খান তার বক্তৃতায় বলেন, মানবতার কবি, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল। মানুষ যা সৃষ্টি করে তা তার শিল্পকর্ম। মানুষ তার সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকে। প্রতিটি মানুষের মাঝে শিল্পী সত্বা বাস করে। কেউ তার সেই সত্বাকে প্রকাশ করতে পারেন, কেউ পারেন না। একজন শিল্পী জগৎ দেখার আগে সে তার সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে দেখে। একজন শিল্পীকে কোন গণ্ডিতে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। শিল্পীর কোন বিশেষ জাত থাকে না। সৃষ্টিশীল মানুষকে কখনো ধর্মের গন্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না। তাইতো আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে কোন বিভেদ করতে পারি না। এরা দুইজনই আমাদের সম্পদ। এই দুইজন সৃষ্টিশীল মানুষ তাদের সৃষ্টি দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে যে স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তার অবদান অনস্বীকার্য।
পরে প্রাচ্য আকাদেমি ও প্রাচ্যসংঘ যশোরের শিল্পীবৃন্দের পরিবেশিত কবি নজরুলের গান ও কবিতা দর্শক সারিতে বসে উপভোগ করেন প্রধান অতিথিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।