# একাদশ শ্রেণির পাঠদান ব্যাহত
# টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ৪৫ জন
# বিয়ে হওয়ায় পরীক্ষা দেবে না ২০ ছাত্রী
# অভিভাবকরা আসেন না মিটিংয়ে
# হোয়াটসঅ্যাপ বা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যোগাযোগ করে অংশ নেন ব্যবহারিক ক্লাসে
# কলেজে এ প্লাস ছাড়া মেলেনা ভর্তির সুযোগ
এসএম জালাল
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ ৮৫ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কলেজের একাদশ শ্রেণীর পাঠদান চলছে জোড়াতালিতে। পাঠদানের চেয়ে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বেশি মনোযোগী। এক ডজন শিক্ষক পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কোচিং ব্যবসায় জড়িত। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন কম, তেমনি শিক্ষকদেরও পাঠদানের আগ্রহ কম। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসে আসেন, তবে ক্লাসে শিক্ষার্থী আসে না।
জানা যায়, এম এম কলেজে একাদশ শ্রেণীতে মোট ৭৩০জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুয়োগ পায়। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৩৬০ জন, মানবিক বিভাগে ১৭৫ জন, বাণিজ্যিক বিভাগে ১৭৫ জন। এ কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া কঠিন। এ প্লাস সাড়া কেউ ভর্তির সুয়োগ পায় না। মেধাবী এ শিক্ষার্থীরা স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে প্রথম দিকে ক্লাসমুখী থাকেন। তবে দিন, মাস বৃদ্ধির সাথে সাথে সেই আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেন। মেধাবী শিক্ষক ও নানা সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও কেন শিক্ষার্থীরা কলেজে আসছে না তা জানতে অনুসন্ধানে নামে বাংলার ভোর পত্রিকা। বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বুধবার বেলা সাড়ে এগারটার দিকে কলেজের বাণিজ্যিক ও মানবিক বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, ক্লাসে উপস্থিতি একেবারে কম। বিজ্ঞান বিভাগে গিয়ে দেখা যায় মূল গেট বন্ধ। গেট নাড়াতেই কর্মরত একজন কর্মচারী বলেন, কি জানতে চান। গেট বন্ধ কেন? তিনি বলেন, কোন শিক্ষার্থীরা যাতে চলে না যায় তাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আজ কত জন উপস্থিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজ্ঞান বিভাগে একাদশ শ্রেণীতে মোট এখন ৩৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আজ ১১০ জন উপস্থিত হয়েছে। তিনি জানান, এখন উপস্থিতি খুব কম।
৫ আগস্টের পর আবার দেশের শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে ফিরছে। শিক্ষার্থীরা এখন ব্যস্ত লেখাপড়ায়। ব্যস্ত শিক্ষক-অভিভাবকরাও। শিক্ষায় গতি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে কোচিং-প্রাইভেট সংশ্লিষ্টরাও তৎপর হয়ে উঠেছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, কলেজে তেমন ভাল লেখা পড়া হয় না। স্যারেরা তেমন গুরুত্ব দিয়ে পড়ান না। তাই কোচিংয়ের বিকল্প নেই। কলেজে গুরুত্ব দিয়ে শেখালে এবং প্র্যাকটিস করালে কোচিংয়ে যেতে হতো না। তাদের কলেজের শিক্ষকরাই কোচিংয়ের শিক্ষক। কলেজের চেয়ে কোচিংয়ে তারা পড়া আদায় করে নেন পাই টু পাই।
শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্য ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজের এক ডজন শিক্ষক পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কোচিং ব্যবসায় জড়িত। এ সব শিক্ষকরা হলেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক মো. শরিফুল হাসান, পদার্থ বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. শেখ খসরুজ্জামান, প্রভাষক মোহাম্মদ তৌহিদুর রহমান, প্রভাষক মো. মহিবুল হাসান, ইংরেজি সহযোগি অধ্যাপক রাশেদ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল জাকারিয়া, সহযোগি অধ্যাপক বিধান ভদ্র, গণিত সহকারী অধ্যাপক অনুপম কুমার দেবনাথ, সহকারী অধ্যাপক পঙ্কজ মন্ডল, রসায়ন সহকারী অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন, প্রভাষক সজীব কুণ্ডু, হিমাংশু বিশ্বাস, হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক মাহাবুবুর রহমান, বাংলা সহকারী অধ্যাপক আহসান মোহাম্মদ ইকরামুল কবীর, প্রভাষক আজিজুর রহমান ।
এ ব্যাপরে উচ্চ মাধ্যামিক কোর্স সমন্বয় কমিটির প্রফেসর সৈয়দ আহসান হাবীব জানান, এম এম কলেজে একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারপরেও তাদেরকে ক্লাসমুখী করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি জানান, কলেজে একাদশ শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয় সকাল ৯ টা শেষ হয় ২ টায়। যারা আসেন তারা প্রথম দুটি ক্লাস করে চলে যায়। এত সময় তারা কেউ কলেজে থাকতে চায় না। তারা কøাস বাদ দিয়ে কোচিং চলে যায়।
তিনি বলেন, এবার অনুষ্ঠিত একাদশ শ্রেণীর টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দেয়নি ৪৫ জন শিক্ষার্থী। তাদের অভিভাবকদের ডাকা হয়েছিল। মিটিংয়ে মাত্র ১২ জন অভিভাবক উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের অনুরোধে ১২ মে (রোববার) আবার টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেয়া হবে। ৪৫ জনের মধ্যে কতজন এ পরীক্ষায় অংশ নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন তা বলা কঠিন। কারণ সব অভিভাবক মিটিংয়ে আসেননি। আর ২০ জন ছাত্রী ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা পরীক্ষা দিবেনা। তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে তারা জানিয়েছে।
তিনি জনান, টিউটোরিয়ালের এই নম্বর বার্ষিক পরীক্ষার সাথে যোগ হবে। নিয়ম রয়েছে কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিলে সে ফেল বলে গণ্য হবে। সে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে পারবে না। তবে তাকে আটকানোর ক্ষমতা নেই কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে। সে আটোমেটিক দ্বিতীয় বর্ষে উঠে যাবে। ফলে কেউ ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে তৎপর নয়।
শিক্ষার্থীরা কিভাবে সিলেবাস শেষ করবে এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর সৈয়দ আহসান হাবীব বলেন, কোচিং সেন্টার বা কলেজ শিক্ষকদের সৃষ্ট প্রাইভেট হোমে প্রতিদিন সকাল-বিকেল-রাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভিড় থাকেই। কলেজের সমান্তরালে শ্রেণিকক্ষের মতো আয়োজন করে এসব জায়গায় পড়ানো হচ্ছে, আদলে পরীক্ষা হয়, ক্লাস হয়, দেয়া হয় হোমওয়ার্ক। তবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ বা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যোগাযোগ করে ব্যবহারিক ক্লাস করতে কলেজে আসে। যা কোচিংয়ে সম্ভব নয়।
এমএম কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারপরেও ক্লাসে উপস্থিতি কম। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কোচিংয়ে দিয়ে লেখা পড়া করান বলে জেনেছি। তিন থেকে চার জায়গায় কোচিং করে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা ক্লাসে আসে না। অভিভাবকরা এ জন্য দায়ী।
তিনি জানান, কলেজের অনেক শিক্ষক কোচিং করায় বলে তিনি শুনেছেন।