বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের মণিরামপুরে কার্ডধারীদের মাঝে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিক্রির জন্য নতুন করে ৪৬ জন পরিবেশক নিয়োগ দিয়েছে উপজেলা খাদ্য বিভাগ। গেল ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার উপজেলা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিশাত তামান্না ও সদস্য সচিব উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহার যৌথ স্বাক্ষরিত এই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ২০২৪ সালের নীতিমালা অনুসরণ না করে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আঁতাত করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মনগড়া পরিবেশক নির্বাচন করা হয়েছে। এ নিয়ে বঞ্চিতদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা কেউ কেউ এই তালিকা বাতিল চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরটির জেলা কার্যালয়ে অভিযোগসহ আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মণিরামপুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২৩ হাজার ৪০০ উপকারভোগীর মাঝে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা দরে মাসিক ৩০ কেজি করে বছরে পাঁচ মাসে চাল বিক্রির জন্য ২৬ জন পরিবেশক ছিল। যারা সবাই আওয়ামী লীগের অনুসারী। গেল বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকজন পরিবেশক আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় চাল বিক্রি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এরপর ওই বছরই নতুন পরিবেশক নিয়োগ সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
উপজেলা খাদ্য দপ্তরের সূত্র মতে, অধিদপ্তরের লিখিত আদেশ পেয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন পরিবেশক চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় উপজেলা খাদ্য দপ্তর। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৯৫টি আবেদন পড়ে। সেখান থেকে যাচাই বাছাই শেষে ১৩টি আবেদন বাতিল করে ১৮২টির বৈধতা দেয় উপজেলা কমিটি।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ২০২৪ সালের নীতিমালার ৫ ধারায় বলা আছে, পরিবেশক নিয়োগের আগে আবেদনকারীদের খাদ্যশস্য রাখার মত গুদাম সক্ষমতা আছে কিনা তা সরেজমিন চেক লিস্টের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে।
এছাড়া আবেদনকারীর সংখ্যা নির্ধারিত পরিবেশক সংখ্যার অতিরিক্ত হলে লটারির মাধ্যমে পরিবেশক চূড়ান্তের নির্দেশনা আছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, এগুলোর কোনটিই অনুসরণ না করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে উপজেলা কমিটির সভাপতি ইউএনও নিশাত তামান্না কমিটির সদস্যদের নিয়ে মনগড়া ৪৬ জন পরিবেশক নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করেছেন।
এদিকে ইউএনও নিশাত তামান্না ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা স্বাক্ষরিত পরিবেশক নিয়োগের নির্বাচিত তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সেখানে দৈবচয়নের (লটারি) মাধ্যমে গত ২৯ এপ্রিল ৪৬ জন পরিবেশক নির্বাচন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশক নিয়োগে বাস্তবে কোন লটারি হয়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহাও লটারি না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের তথ্যমতে, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পরিবেশক নিয়োগ পেতে রোহিতা ইউনিয়ন থেকে ১২ জন, কাশিমনগর ইউনিয়ন থেকে নয় জন, ভোজগাতী ইউনিয়ন থেকে ছয় জন, ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন থেকে ১৯ জন, হরিদাসকাটি ইউনিয়ন থেকে আট জন, মণিরামপুর সদর ইউনিয়ন থেকে পাঁচ জন, খেদাপাড়া ইউনিয়ন থেকে ১৩ জন, হরিহরনগর ইউনিয়ন থেকে সাত জন, ঝাঁপা ইউনিয়ন থেকে ১৫ জন, মশ্মিমনগর ইউনিয়ন থেকে ১২ জন, চালুয়াহাটি ইউনিয়ন থেকে ২৪ জন, শ্যামকুড় ইউনিয়ন থেকে ২০ জন, খানপুর ইউনিয়ন থেকে ১৪ জন, দুর্বাডাঙ্গা ইউনিয়ন থেকে ১০ জন, কুলটিয়া ইউনিয়ন থেকে ১২ জন, নেহালপুর ইউনিয়ন থেকে ছয় জন ও মনোহরপুর ইউনিয়ন থেকে তিন জন আবেদন করেছেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫ জন আবেদনকারীর মধ্যে ১৮২ জনের আবেদন বৈধতা পেলেও লটারির মাধ্যমে পরিবেশক নিয়োগ চূড়ান্ত না করে ইউএনও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কাছ থেকে তালিকা নিয়ে অধিকাংশ দলীয় পদ-পদবীধারী ৪৬ জন পরিবেশক নিয়োগ চূড়ান্ত করেছে। যার মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীরা ৩৬টি, জামায়াত ইসলাম সাতটি, জমিয়তে ওলামা ইসলাম দুইটি ও ইসলামী আন্দোলন একটি পরিবেশক পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, এক্ষেত্রে পরিবেশকপ্রতি একলাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। যার মধ্যে ইউএনও ১২-১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। ইউএনও নিশাত তামান্না তার স্বামীর মাধ্যমে এই টাকার লেনদেন সেরেছেন। যদিও এই বিষয়ে শক্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কাগজপত্রে বৈধতা পেয়েও চূড়ান্ত পরিবেশক নিয়োগ না পাওয়া কয়েকজনের সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। দলীয়ভাবে চাপে পড়তে পারার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, আমরা খাদ্যবান্ধবের পরিবেশকের জন্য আবেদন করেছিলাম। আমাদের বিষয়ে সরেজমিন কোন তদন্ত হয়নি। ডিলার (পরিবেশক) নিয়োগ চূড়ান্তের জন্য লটারির কথা বলা হলেও আমাদের উপজেলায় ডাকা হয়নি। লটারি না করে হঠাৎ শুনি টাকার বিনিময়ে ভাগবাটোয়ারা করে ৪৬ জন ডিলার নিয়োগ হয়ে গেছে। আমরা এই বিষয়ে ইউএনওর কাছে জবাব চাইবো। প্রয়োজনে এই অনিয়মের নিয়োগ বাতিলের জন্য আদালতে শরণাপন্ন হবো।
এই বিষয়ে মণিরামপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, ‘খাদ্যবান্ধবের পরিবেশকের জন্য ১৯৫ টি আবেদন পড়েছে। লোকবল কম থাকায় আমরা আবেদনকারীদের গুদামের সক্ষমতা যাচাইয়ের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করতে পারিনি। গত ২৯ এপ্রিল বিকেলে ইউএনওর কক্ষে উপজেলা কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে ৪৬ জন পরিবেশক নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। যারা চূড়ান্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে আমরা কয়েকজনের বিষয়ে সরেজমিন যাচাই করে দেখব। লটারির মাধ্যমে পরিবেশক চূড়ান্ত করা হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নে ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, লটারি হয়নি। ইউএনওর সিদ্ধান্তে কমিটি কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করেছেন।
এদিকে খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহার বক্তব্যের সাথে কমিটির সভাপতি ইউএনওর বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না বলেন, ‘নীতিমালায় লটারির কথা উল্লেখ ছিল। আমরা কয়েকটি ইউনিয়নে পরিবেশক নিয়োগে লটারি করেছি। কোন কোন ইউনিয়নে যাচাইবাছাই শেষে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার পর কোটার সাথে আবেদন সংখ্যা মিলে যাওয়ায় লটারির প্রয়োজন হয়নি। এক প্রশ্নে ইউএনও বলেন, আবেদনে কারও রাজনৈতিক পদপদবীর উল্লেখ নেই। এখানে ভাগবাটোয়ারার কিছু হয়নি। যারা বাদ পড়েছেন তারা এমন কথা বলছে। আসলে এরকম কোন ঘটনা এখানে নেই।’