হাসান আদিত্য
একতলা ভবনের সামনে শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। ঘরের পাঁচটি কক্ষ। একটি কক্ষে বিলাপ করছেন ষাটোর্ধ্ব ফরিদা বেগম। ছেলের শোকে তিনি বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন কয়েকজন নারী। তাঁরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে মাঝে মধ্যে তিনি বলে উঠছিলেন, ‘আমরা সহজ সরল জীবনযাপন করি। আমরা মানুষের কোনো ক্ষতি করি না। চাঁদার জন্য আমার ছেলেডারে মেরে ফেললো। ছেলেডার তার বাবার মতো একই পরিণতি হলো।’ ২১ বছর আগে দুবৃর্ত্তদের হাতে স্বামী ইব্রাহিমকে হারান ফরিদা। এতদিন ছেলে জিয়াউদ্দিন পলাশকে আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। স্বামীর মতো ছেলের একই পরিণত হওয়ায় শোকের পাথর তিনি। চোখে মুখে তার বিষাদের ছায়া।
শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পলাশকে নওয়াপাড়া নৌ বন্দর এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ভবনের নিচতলায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে যায় দুবৃর্ত্তরা। পলাশ নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। পুলিশ ও স্বজনেরা বলছে, নৌ বন্দরের ঘাট দখলকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এলাকার লোকজন রইচ সিকদার (৩৫) নামের এক বিএনপি নেতাকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রইচ নওয়াপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির প্রচার সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি নওয়াপাড়া পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই দশক আগে নিহত পলাশের বাবা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও শ্রমিক নেতা ইব্রাহিম হাসান সরদার ঘাট দখলের পূর্ব বিরোধে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুনের শিকার হন। বাবার মত ছেলেরও একই পরিণত হওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রোববার যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। বিকালে পলাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাবাসী ও স্বজনের ভিড়। একতলা আধা সমাপ্ত বাড়িতে স্বজন ও এলাকাবাসীর আহাজারি। একটি গাছ তলাতে নিহত পলাশের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান লেলিন কাঁদছেন। তাকে ঘিরে স্বজনেরা শান্তনা দিচ্ছেন। বাড়ির ভিতরে একটি কক্ষে আধো শোয়া অবস্থায় আছেন পলাশের স্ত্রী শারমিন নাহার রত্না (৩৫)। তাঁকে ফিরে আছে তাঁর দুই ছেলে তাসিন সরদার (১০ বছর ছয় মাস) এবং তাইফ সরদার (৯ মাস)। তাদের ঘিরে আছেন কয়েকজন নারী। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শারমিন নাহার। মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার সন্তানদের এখন কে দেখবে। তারা কাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে। আমার সন্তানের পিতা হত্যার বিচার চাই’।
পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পলাশ বাড়ির কাছে তেঁতুলতলা মসজিদের পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। এ সময় রইচ সিকদারের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন চায়ের দোকান থেকে জিয়াউদ্দিন পলাশকে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটের দিকে দুই ব্যক্তি পলাশের বাড়িতে যায়। তাদের একজন নিজেকে জিহাদ এবং অপরজন সাগর নামে পরিচয় দেয়। তাঁরা শারমিন নাহার রত্নার সঙ্গে তাঁদের একজনের মুঠোফোনে জিয়াউদ্দিন পলাশের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। পলাশ তার স্ত্রীকে তিনি মার্ডারের হওয়ার অবস্থায় আছেন বলেন জানান। তিনি তাঁকে ওই দুই ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলেন। তারা টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর জিয়াউদ্দিন পলাশকে নওয়াপাড়া বুড়িরঘাট এলাকায় আয়কর অফিসের পেছনে ভৈরব নদের তীরে বালুর স্তুপের ওপর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে ফেলে রেখে যায়। এলাকার লোকজন তাকে খুঁজে পেয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে রাত ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এ সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমাদুল করিম। মামলা প্রক্রিয়াধীন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নিহত পলাশ আওয়ামী লীগে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নওয়াপাড়া নৌ বন্দরের একটি ঘাট দখলকে কেন্দ্র করে রইচ সিকদার নামে স্থানীয় বিএনপি কর্মীর সঙ্গে পূর্ববিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জেরে রইচ রাতে পলাশকে তুলে এনে আয়কর অফিসের পিছনে একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ফেলে যায়। পরে রইচকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশকে সোপর্দ করে। এই ঘটনায় রইচকে আটক দেখিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে।’