প্রতীক চৌধুরী ও হাসান আদিত্য
সাজানো গোছানো ঘর-গৃহস্থালি ছিল তাদের। এখন সব জলের নিচে। উঠোনে কোমর সমান জল। রান্নাঘর, শোবারঘর, গোয়ালঘরে জল উঠেছে হাটুসমান। বারান্দা থেকে রাস্তা পর্যন্ত বাঁশের সাঁকোই বের হওয়ার একমাত্র পথ। জল আর একটু বাড়লে ছাড়তে হবে বাড়িঘর। এমন পরিস্থিতিতে চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে সময় পার করছেন তারা।
কথাগুলো বলছিলেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামের গৃহবধূ সুপ্রিয়া বৈরাগী। তার মত একই অবস্থা কেশবপুর উপজেলার মধ্যকূল গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমানের। তিনি বলেন, টানা বর্ষণে বাড়ির উঠানে হাটুপানি জমেছে। জলবদ্ধতায় পানি বন্দি হয়ে পড়েছি। সবজি ক্ষেতেও ডুবে গেছে। চরম ভোগান্তির মধ্যদিয়ে বসবাস করছি। হরিহর নদীর স্লুইস গেটের ঠিকমত পানি নিস্কাশন না হওয়ায় এই অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু সুপ্রিয়া বৈরাগী কিংবা মোস্তাফিজুর রহমান নন, তাদের মত যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা তথা ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ এবারও জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। গেল দু’বছর পানির জলাবদ্ধতা না থাকলেও চলতি মাসের টানা বৃষ্টিতে ফের তলিয়ে গেছে এ অঞ্চল।
পানি ঢুকে পড়েছে ঘর-বাড়িতেও। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে মানুষ।
অভিযোগ রয়েছে, চার দশকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি। দ্রুত পানি নিস্কাশন, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে যশোর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রিজিবুল ইসলাম বলেন, অভয়নগর, কেশবপুর ও মণিরামপুর উপজেলার ৩১টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার ৩৪১টি গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতা পানি বন্দি হয়েছে।
এরমধ্যে ২৮ হাজার পরিবারের এক লাখ ৩১ হাজার মানুষ রয়েছেন। জলাবদ্ধ এলাকার মানুষের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০ মেট্টিক টন চাল ও নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শিগগিরই সাহায্য সহায়তা বিতরণ করা হবে।’
চলতি মাসে ভারি বৃষ্টিপাতে ফের জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন ভবদহ এলাকার মানুষ। যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। খেতের ফসল, ঘেরের মাছ সবই কেড়ে নিয়েছে এই পানি। কেড়ে নিয়েছে মানুষের থাকার জায়গাটুকুও। যে পানির অপর নাম জীবন, সেই পানিই এখন জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানি নিস্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী, হরি, হরিহর নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নদী দিয়ে পানি নামছে না। বৃষ্টি হলেই এলাকার বিলগুলো উপচে ভবদহ অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ তলিয়ে যায়।
এ বিষয়ে ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, গত ৪৪ বছরে ভবদহ এলাকা সংস্কারের নামে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ঠিকাদার চক্র লুটপাট করেছে।
ফলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পেও সুফল মেলেনি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি, জরুরি কর্মসূচির আওতায় টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খাল দ্রুত সংস্কার, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবসহ সিণ্ডিকেটের বিচার করতে হবে।
এ বিষয়ে ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, জলবদ্ধতার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জনপ্রতিনিধিরা দায়ী। বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের নামে লুটপাট হয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য টিআরএম চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কার জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে ৯টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানোর কাজ চলছে।
একই সাথে হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পুনঃখনন কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে সভা করা হয়েছে। শিগগির আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ভারি বৃষ্টিতে ভবদহ এলাকা বেশি প্লাবিত হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি নিস্কাশনের কাজ বন্ধ ছিল। এতে ভোগান্তি দ্বিগুণ হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ভবদহ স্লুইসগেটের ওপর বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানোর কাজ চলছে। এছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে জানানো হবে।