কাজী নূর
‘যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা- ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু- বৌদ্ধ- মুসলিম ক্রিশ্চান/গাহি সাম্যের গান।’ অথবা ‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু- মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ এমন ক্ষুরধার লেখনির মধ্যে দিয়ে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যিনি বারবার বলেছেন তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি ধ্রুবতারা। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, সাম্যের কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি; তিনি যৌবনের দূত।
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২। কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে ১৮৯৯) অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। তার ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিলো মাদ্রাসায়। জীবন জীবিকার তাগিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন। সেই ব্যক্তি আবার বলেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। নজরুল তার জীবনে ও মননে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে গেছেন। নজরুল কখনো কোন ধর্মের বিরুদ্ধে বলেননি। সবসময় সোচ্চার ছিলেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি তার চার সন্তানের নাম রেখেছেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। ধর্মের ভিত্তিতে তিনি কখনো ভেদাভেদ করেননি। তিনি খুঁজেছেন মানুষ এবং অমানুষের মধ্যে পার্থক্য। তার কাছে ধর্ম, গোত্র, জাত-কুল, ধনী গরিব সব শ্রেণির মানুষ ছিল সমান। তাই তো তিনি ‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক/ভালো হোক ভালো/এই বিদ্বেষ- আঁধার দুনিয়া তার প্রেমে আলো হোক, আলো/সব মলিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে/তাহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে।’ আবার লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান’। নজরুলের এই লেখনি প্রমাণ করে তিনি মানুষকে কত বড় স্থান দিয়েছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ- রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘কারার ঐ লৌহ- কপাট’ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আবার মুসলিম সংস্কৃতির বড় উৎসব ঈদ উল ফিতর নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে/শোন আসমানী তাগিদ।’ আবার তিনি হিন্দু ভক্তিগীতি ও শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন। শুধু মাতৃরূপে নয়, কন্যারূপেও নজরুল কালীর বন্দনা করেছেন, ‘আদরিণী মোর শ্যামা মেয়েরে/কেমনে কোথায় রাখি/রাখিলে চোখে বাজে ব্যথা বুকে/বুকে রাখিলে দুখে ঝুরে আঁখি।’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল তার সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি- বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের (১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ কবির এই ইচ্ছার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।