তালা সংবাদদাতা
 রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল কৃষি পদ্ধতি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা রক্ষায় এখন জৈব সারই কৃষকদের নতুন ভরসা। সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার শিবপুর গ্রামের পরিশ্রমী কৃষি উদ্যোক্তা মোড়ল আব্দুল মালেক সেই পরিবর্তনের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাত্র ১৮টি কেঁচো দিয়ে তিনি শুরু করেন ভার্মি (কেঁচো) কম্পোস্ট উৎপাদন। দীর্ঘ এক দশকে তার অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে একটি আদর্শ জৈব সার খামার। বর্তমানে তার খামারে প্রতি মাসে প্রায় ১৫ টন ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার উৎপাদিত হয়। এই সারের চাহিদা এখন শুধু তালা উপজেলাতেই নয়, খুলনা, যশোর ও ঢাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে ৫ শতাধিক কৃষককে নিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট সারের প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে জেলায় প্রায় ৫০ হাজার ছোট-বড় খামারি নিয়মিতভাবে জৈব সার উৎপাদন করছেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত সার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
 কৃষি উদ্যোক্তা মোড়ল আব্দুল মালেক বলেন, শুরুর দিকে মানুষ হাসাহাসি করত-কেঁচো দিয়ে আবার কৃষি হয় নাকি! এখন তারা নিজেরাই এসে সার কিনছে। আমার খামারে দুই ধরনের সার উৎপাদিত হয়—ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট। প্রায় আড়াই বিঘা জায়গায় এই খামার পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে নিয়মিত আট-দশজন শ্রমিক কাজ করেন।
তিনি আরও বলেন, ট্রাইকো কম্পোস্ট মাটির জৈব উপাদান পুনরুদ্ধার করে, ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস করে এবং উপকারী পোকামাকড় বাঁচিয়ে রাখে। এতে উৎপাদন খরচ কমে যায়, ফলন বাড়ে ও পরিবেশও সুরক্ষিত থাকে।
তালা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুসারে, এ উপজেলায় বর্তমানে প্রায় ১২০টির বেশি ক্ষুদ্র জৈব সার উৎপাদন খামার চালু রয়েছে। এসব খামারের পণ্য স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। অনেক কৃষক এখন জৈব সার উৎপাদনকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করছেন।
তার মেয়ে শাহিনূর ইয়াসমিন শিলা, যিনি বাবার সঙ্গে এই উদ্যোগে কাজ করেন, জানান-“নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জৈব সারই ভবিষ্যতের পথ। সরকার যদি রাসায়নিক সারের মতো জৈব সারও সহজলভ্য করে, তাহলে কৃষক যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি দেশও পাবে বিষমুক্ত খাদ্য।”
স্থানীয় কৃষক মুকুল সরদার বলেন, আগে রাসায়নিক সার দিয়ে ফসল তুললেও মাটির শক্তি নষ্ট হয়ে যেত। এখন কেঁচো সার ব্যবহার করে দেখি ফলনও ভালো হচ্ছে, মাটিও নরম ও উর্বর হচ্ছে। এই সারে ধান, সবজি, কলা-সব ফসলেই ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
তালা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাজেরা খাতুন বলেন, ভার্মি কম্পোস্ট শুধু সার নয়, এটি একটি পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি। মাটির জীববৈচিত্র্য রক্ষা, গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কৃষকরা এখন এই সারের উৎপাদন ও ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। আমরা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছি। তিনি আরও বলেন, জৈব সার ব্যবহারে মাটির স্বাস্থ্য টিকিয়ে রাখা যায়। এটি মাটির জীবাণু ও পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য রক্ষা করে। রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য জৈব সারই হতে পারে ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি সমাধান।
 অন্যদিকে, কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভার্মি কম্পোস্ট ও ট্রাইকো কম্পোস্ট শুধু ফসল উৎপাদন বাড়ায় না, বরং এটি মাটির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাও বজায় রাখে। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরও বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশ খুব দ্রুত একটি জৈব কৃষি নির্ভর দেশে পরিণত হতে পারবে।
 
 