সুমন ব্রহ্ম, ডুমুরিয়া (খুলনা) থেকে
টানা বৃষ্টিতে উপজেলার বেশিরভাগ খাল-বিল, চিংড়ি-ঘের, সবজি ক্ষেত, পানিতে তলিয়ে থাকায় অধিকাংশ মানুষের আয়-উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার দুর্যোগে পড়া দিনমজুর-দরিদ্র কৃষক অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটালেও কপালে জুটছে না তেমন কোনো খাদ্য-সহায়তা।
‘চিংড়ি ঘেরে মাছ-সবজি-ধান চাষ কেন্দ্রীক’ জীবন-জীবিকা নির্ভর সমগ্র উপজেলার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-সাধারণ মানুষের জীবনে এবারের অতি-বৃষ্টিতে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২ মাসের অতি-বর্ষণে ২০ হাজারের অধিক চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছ ও অবকাঠামোর আনুমানিক ক্ষতি দেড়’শ কোটি টাকা। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমান সবজির জোগানদাতা এই ডুমুরিয়ায় ঘেরের আইলের পাশাপাশি ক্ষেতের নানা প্রকার সবজির আনুমানিক ক্ষতি ২শ’ কোটি টাকা। এই জলাবদ্ধতার কারণে আসন্ন বোরো ধানের চাষাবাদ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কৃষকরা মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ২’শ ৪১টি গ্রামের মধ্যে অধিকাংশ গ্রামের বিল-চিংড়ি ঘের তলিয়ে বাড়ি-ঘর রাস্তা-ঘাটেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে ধামালিয়া ইউনিয়নের বরুণা, কাঠেঙ্গা, চেচুড়ী-সহ ৮টি গ্রাম, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর, মুজারঘুটো-সহ ১০টি গ্রাম, রুদাঘরা ইউনিয়নের খরসঙ্গ, মিকশিমিল, হাসানপুরসহ পাঁচটি গ্রাম, খর্ণিয়া ইউনিয়নের সিংগা, পাঁচপোতা-সহ পাঁচটি গ্রাম, আটলিয়া ইউনিয়নের আধারমানিকসহ আটটি গ্রাম, মাগুরাঘোনা ইউনিয়নের ঘোষড়া, কাঞ্চনপুরসহ আটটি গ্রাম, শোভনা ইউনিয়নের বারইকাঠি, বাগাছড়াসহ চারটি গ্রাম, শরাফপুর ইউনিয়নের আকড়াসহ পাঁচটি গ্রাম, সাহস ইউনিয়নের লতাবুনিয়াসহ চারটি গ্রাম, ভাণ্ডারপাড়া ইউনিয়নের তেলিখালি, পেড়িখালি, ধানিবুনিয়াসহ পাঁচটি গ্রাম, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের মির্জাপুর, বিলপাটিয়ালা, সাজিয়াড়াসহ পাঁচটি গ্রাম, রংপুর ইউনিয়নের রংপুর, সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি, ঘোনা, শান্তিনগর, শলুয়া, রামকৃষ্ণপুরসহ চারটি গ্রাম, গুটুদিয়া ইউনিয়নের লাইন বিলপাবলা, বিলপাবলা, লতাসহ পাঁচটি গ্রাম ও মাগুরখালি ইউনিয়নের কাঞ্চননগর-সহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
তবে এসব প্লাবিত এলাকার মধ্যে রংপুর ইউনিয়নের সাড়াভিটা, বটবেড়া, মাগুরাঘোনা ইউনিয়নের ঘোষড়া, কাঞ্চনপুর, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের মির্জাপুর, বিলপাটিয়ালা, খর্ণিয়া ইউনিয়নের সিংগা, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর, ও আটলিয়া ইউনিয়নের আধারমানিক গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। এসব গ্রামের বেশিরভাগ কাচা ঘর-বাড়ি ইতোমধ্যে পড়ে গেছে, অধিকাংশ মানুষ খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিনাতিপাত করছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতেগোনা কিছু মানুষ নামুুনা মাত্র কিছু চাল পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই নগণ্য।
এ প্রসঙ্গে রংপুর ইউনিয়নের ঘোনা গ্রামের মলি মল্লিক বলেন, আমাদের গ্রামে সব ঘের-ভেড়ি তলানে। কারো কোনো কাজ-কাম নেই। শতাধিক পরিবারের বসত ঘরে পানি উঠে গেছে। এখনও কোনো রকম সাহায্য পাইনি। রুদাঘরা ইউনিয়নের শোলগাতিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র সবজি বিক্রেতা জিয়াউর রহমান বলেন, আগে এলাকার ঘের-ভেড়ি থেকে সবজির ব্যবসা করে সংসার চালাতাম। এই বর্ষায় তলায়ে সব সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমার কোনো কাজ নেই। খুব কষ্টে জীবন-ধারণ করলেও কোনো সহায়তা পাইনি। ডুমুরিয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের রুইদাস মণ্ডল বলেন, কিছুদিন আগে বিএনপি’র এক নেতা কিছু চাল-আলু দিলো, তাছাড়া কোনো সাহায্য পাইনি।
এলাকার সচেতন নাগরিক মোশাররফ হোসেন কচি বলেন, দীর্ঘ সময়ের এই জলাবদ্ধতায় চাষি-দিনমজুরের কোনো কাজও নেই, মানে খাবারও নেই। তাছাড়া বেশিরভাগ দরিদ্র কৃষক এনজিও’র কাছে কিস্তির জালে বাঁধা। উপজেলার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত রংপুর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় সকল ঘেরভেড়ি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে আছে। অধিকাংশ মানুষের কোনো কাজকাম না থাকায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি ও মুজারঘুটা গ্রামে হাজারের অধিক পরিবারের জন্য জরুরি খাদ্য সাহায্য প্রয়োজন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন বলেন, গত ২ মাসে আমরা উপজেলার সকল ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য তিন-ধাপে মোট ৪৩ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বিতরণ করেছি। তবে রংপুর, রঘুনাথপুর, ডুমুরিয়া, খর্ণিয়া, মাগুরাঘোনা ও আটলিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে মানুষের খুব দুরাবস্থা চলছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাসনিম জাহান বলেন, সমগ্র ডুমুরিয়া উপজেলার প্রায় সকল চিংড়ি ঘের, সবজি ক্ষেত, বাড়িঘর, গ্রামীণ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। হাজার-হাজার দুর্গত প্রান্তিক মানুষের জন্য আরও খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন উল্লেখ করে জেলায় চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।