বাংলার ভোর প্রতিবেদক
খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাট। ঈদ পরবর্তী দ্বিতীয় হাট ছিলো শনিবার। প্রথমদিনের চেয়ে এদিন হাট জমজমাট লক্ষ্য করা গেছে। পর্যাপ্ত চামড়া উঠার সঙ্গে দূর দূরান্ত থেকে শীর্ষস্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের আনোগোনাও দেখা গেছে। তবে চামড়ার দাম নিয়ে আড়তদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। আড়তদারা বলছেন, তারা উপযুক্ত দামই দিয়েছেন। ক্ষেত্র বিশেষ সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দিয়েও চামড়া কিনেছেন। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এবারও চামড়ার দাম পাননি।
পাড়া-মহল্লা থেকে বেশি দামে চামড়া কিনে বাজারে এসে দাম না পেয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন। এতে লাভ তো দূরের কথা পুঁজিও ওঠেনি অনেকের। সব কিছুর দামই বেশি। কেবল চামড়ার দামই কম।
খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট বসে রাজারহাটে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার হাট বসে এখানে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চামড়ার ক্রেতা- বিক্রেতারা এই মোকামে ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসেন। গত সোমবার কোরবানি ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদের পরদিন মঙ্গলবার ছোট পরিসরে কেনাবেচা হয়। শনিবার বৃহৎ পরিসরে হাট বসে। মূল বাজার ছাড়িয়ে আশেপাশে ছাড়িয়ে সড়কের পাশে চামড়া নিয়ে বসে ব্যবসায়ীরা।
এদিন সকালে যেয়ে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পরিবহন থেকে নামিয়ে চামড়া স্তুপ করে রাখছেন। আবার স্থানীয় আড়তদাররা ওইসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্তুপ করা চামড়া ওলট-পালট করে দেখছেন। দাম নিয়ে দু’পক্ষকেই কসাকসি করতেও দেখা গেছে। এদিন ৮০ হাজার বা দুই লাখ টাকার একটি গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
অন্যদিকে ছাগলের চামড়া কিনছেনই না ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা পর্যন্ত ছাগলের চামড়ার দাম পেয়েছেন। এদিকে এবার দেখেশুনে চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। ত্রুটিপূর্ণ চামড়া দেখলেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া কোরবানির পর পশুর চামড়া বিক্রি করতে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও। তারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কোরবানির পশুর চামড়া।
খুলনার পাইকগাছা থেকে আসা রাজ কুমার বলেন, ‘তারা স্থানীয় পাঁচজন মিলে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজি তৈরি করেন। সেই পুঁজি দিয়ে ঈদের দিন পাড়া-মহল্লা ঘুরে ঘুরে চামড়া কেনেন। তার ভাষ্য এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় ছোট গরুর চামড়া, ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় মাঝারি আকৃতির গরুর চামড়া এবং ৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বড় গরুর চামড়া কিনেছেন। কিন্তু আড়তে আনার সব গড়ে সব চামড়ার দামই ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এমনিতে দাম কম, তার ওপর এই কাঁচা চামড়া লবণজাত করে সংরক্ষণ করলে তারা আরও ক্ষতির মুখে পড়বেন।
আর তারা সেই চামড়া সরাসরি ট্যানারিতে পৌঁছাতেও পারবেন না। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে একরকম বাধ্য হয়েই কম দামে গরুর চামড়া আড়তে বিক্রি করেছেন। এছাড়া ছাগলের চামড়ার দাম গড়ে ১০ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। কাটা-ফাটা চামড়া ফেলে দিয়েছেন।’
যশোর সদরের ইছালি গ্রামের বিশ্বজিৎ কুমার ১২২ পিস গরু ও ২০ পিস ছাগলের চামড়া নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কাক্সিক্ষত দাম না পেলেও সব চামড়া বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, গত ২০ বছর ধরে এই ব্যবসার সাথে আমি জড়িত, কিন্তু চামড়ার এরকম দরপতন গত ৩-৪ বছর ধরে চলছে। সরকার নির্ধারিত ৫০ টাকা ফুট হলেও দাম পাওয়া যাচ্ছে ২৫ টাকা ফুট হিসেবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা, লবণ লাগানো এবং পরিবহন খরচ মিলিয়ে যে চামড়ার দাম প্রতি পিস ৮-৯শ টাকা পড়েছে, সেই প্রায় একই দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি।
লোকসানের কথা জানিয়েছেন খুলনার পাইকগাছার স্বপন দাসও। তিনি জানান, ‘তিনি ২৪৮ পিস গরুর চামড়া ও ৪৪ পিস ছাগলের চামড়া রাজারহাটে এনেছেন। বড় চামড়া বিক্রি করেছেন ৭শ’ টাকায়, আর ছাগলের চামড়া প্রতি পিস ২০ টাকা করে। অর্থাৎ গরুর চামড়া বিক্রি করেছি ২৫ টাকা ফুট হিসেবে। অথচ সরকার নির্ধারণ করেছে ৫০ টাকা বর্গফুট করে। যে কারণে আমাদের মতো খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেনা। লাভের মুখ দেখছেন আড়তদার আর ট্যানারি মালিকরা।’
তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত নাম পাচ্ছে না এমন অভিযোগ মানতে নারাজ স্থানীয় আড়তদাররা। আড়তদারদের দাবি, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছেন তারা। তবে কাটা ফাটা চামড়ার দাম কম। অনেকে ক্ষেত্রে তারা নেননি বলেও জানিয়েছেন।
স্থানীয় আড়তদার হাসানুজ্জামান হাসু জানান, ‘সাধারণত বড় আকৃতির গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট হয়, মাঝারি আকৃতির গরুর চামড়া ২১-৩০ এবং ছোট আকৃতির গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। একেকটি গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ও শ্রমিকের মজুরিসহ গড়ে ৩০০ টাকা খরচ হয়। গত বছরের তুলনায় এবার লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় খরচ কিছুটা বেশি পড়ছে। এরপরও তারা ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে কাঁচা চামড়া কিনেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দাম দিয়েছেন। এখন এসব চামড়া লবণজাত করতে তাদের খরচ বেড়ে গেছে।’
আড়তদার ও জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল জানান, ‘শনিবার রাজারহাটে গড়ে ৭০ হাজার পিস চামড়া উঠেছে। এর মধ্যে গরুর চামড়া ছিল ৪০ হাজার পিস। যেখানে ৩ কোটি টাকার হাতবদল হয়েছে। তিনি বলেন, ভালোমানের গরুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে অথবা কাছাকাছি দামে বিক্রি হয়েছে। খারাপ চামড়ার দাম কমবে এটাই স্বাভাবিক। খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি থেকে কম দামে কিনে অনেক বেশি দাম চেয়ে থাকে। তবে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির উদ্যোগ নিলে এখাত আরও বিকশিত হবে। আবার সরকার খুচরা চামড়া ব্যবসায়ীদের অল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করলে চামড়া ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে।’
ছাগলের চামড়ায় আগ্রহ নেই:
চলতি বছর খাসি ও বকরির দাম বাড়ানো হয়েছে। গত বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত খাসির চামড়ার দাম ছিল ১৮-২০ টাকা। এবার সেটি বাড়িয়ে ২০-২৫ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে, বকরির চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি বেড়েছে ৬ টাকা। তবে বাস্তবে খাসি ও বকরির চামড়ার দাম এবার বাড়েনি।
মণিরামপুর গোপাল দাস নামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খাসির চামড়ার স্তুপের সামনে বসে থাকতে দেখা গেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি চামড়া ২০ থেকে ৫০ টাকা টাকা করে কিনেছেন। লবণ লাগানো, শ্রমিক এসব দিয়ে আরোও খরচ হয়েছে। এখন সেই চামড়া হাটে এনে কেনা দামেও চাচ্ছে না। এখন তো আমার চালানও বাঁচতেছে না। ঋণ নিয়ে চামড়া কিনেছিলাম। এখন এ টাকা শোধ করবো কিভাবে। গোপালের মতো এদিন রাজারহাটে অনেকেই ছাগলের চামড়ার স্তুপ নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। তারাও ছাগলের চামড়া না কেনার অভিযোগের কথা জানিয়েছেন।
ভাইরাসে ফেটে যাচ্ছে চামড়া, ফিরিয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের লবণজাতের পর চামড়াতে অজ্ঞাত ভাইরাসে ফেটে যাচ্ছে চামড়া। ফলে এবার দেখেশুনে চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। ত্রুটিপূর্ণ চামড়া দেখলেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন তারা।
যশোরের স্থানীয় আড়তদার ও ঢাকার এক ট্যানারি মালিকের প্রতিনিধি হাসিবুল হক জানান, ‘হাটে ভালোমানের গরুর চামড়া সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। খারাপ চামড়া কম দামে বিক্রি হয়েছে। কেননা এবার চামড়ায় এক ধরনের ভাইরাস লেগে ফেটে যাচ্ছে। যে কারণে দাম পড়ে গেছে। দেখেশুনে না কিনলে আমাদের পথে বসতে হবে। কারণ ট্যানারি মালিকরা ফেটে যাওয়া চামড়া কিনবেনা।’
কুষ্টিয়ার ট্যানারি মালিকের প্রতিনিধি এহসান রিপন জানান, ‘এক ধরনের ভাইরাসে অন্তত ১৫ শতাংশ চামড়া ফেটে যাচ্ছে। আবার ঠিকমত লবণ না দেয়ায় চামড়া নষ্ট হয়ে পড়েছে। যে কারণে চামড়ার দাম কমে গেছে। তবে ভালো মানের চামড়া ভালো দাম দেয়া হচ্ছে।’
সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর চামড়ার দর পতন ঘটেছে। সরকার ফুট হিসেবে চামড়া দর বেঁধে দিলেও এই মোকামে ফুট হিসেবে কোনো চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে না। ট্যানারি কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে কাচা চামড়ার বাজারে এই দূরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। এককালের রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্প সরকারের উদাসীনতার কারণে ধ্বংসের প্রান্তে পৌঁছে গেছে।