# চারদিন পর হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দুটি মামলা
# ঘের নয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে তরিকুল খুন ভাইয়ের দাবি
হাসান আদিত্য
কর্দমাক্ত গলির পথেই পোড়া মোটরসাইকেলের কঙ্কাল। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ল জড়ো করা পোড়া লেপতোশক, কাপড়চোপড়। আরেক পাশে টালির রান্নাঘর। দেয়াল থাকলেও উপরের ছাউনি পোড়া। ভিতরে প্রবেশ করলেই অর্ধপোড়া স্টিলের থালা, মগ গামলা, হাঁড়ি পড়ে আছে। ঘরগৃহস্থলির ব্যবহৃত জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় চেনার উপায় নেই। পাশেই দুই কক্ষের দো-চালা টিনের ঘর। ঘর থাকলেও নেই ছাউনি। টিনগুলো পুড়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। পুড়ে কয়লা হয়েছে ঘরের ছাউনিতে দেয়া বাঁশ কাঠও। ঘরের ভিতরে পুড়ে কঙ্কাল ফ্রিজ, খাট, চেয়ার টেবিল, ফ্যান। ধংসস্তুপের এই দৃশ্য যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ার বিষ্ণু বিশ্বাস ও শিউলি বিশ্বাস দম্পতির বাড়ির। সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের এই বাড়িতে গত বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছিলো; এমন মুহর্তে কয়েকজন দুর্বৃত্ত বাড়িতে এসে হামলা চালায়। তাদের দেয়া আগুনে কয়েক ঘন্টা পুড়ে ছাই বছরের পর বছর সাজানো গোছানো সংসার।
অগ্নিকাণ্ডে ছড়িয়ে পড়া আগুন গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নিভলেও এখন বাড়িটির দৃশ্যমান হয়েছে পোড়া কঙ্কাল। মাথা গোঁজার ঠাই হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে গত চার দিন যাবত পার করছেন তারা। ঘটনার পর থেকে এখনো আতংকে ফেরেনি বাড়িটির পুরুষ সদস্যরা। বয়স্ক শ্বাশুড়ি নিয়েই পোড়া বাড়িতে ফিরেছেন শিউলি বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ঘরে টিভি, ফ্রিজ, সোনাদানা, পাসপোর্ট, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল। এখন আর কিচ্ছু নেই। শুধু বাড়ির ছয়জন মানুষ বেঁচে আছি। পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই। আতংক, হারানোর বেদনার মধ্যে যোগ হয়েছে দুর্ভোগ উল্লেখ করে এই নারী বলেন, ‘যখন বাড়ি ঘর পুড়ছিলো, তখন ভগবানরে ডাকছিলাম, আর বলছিলাম বৃষ্টি দাও। কিন্তু সেদিন দিলো না। তার পর থেকে প্রতিদিন বৃষ্টি। একদিকে মাথা গোজার ঠাঁই নেই; অন্যদিকে বৃষ্টি। ফলে দিনভর ভিজে খোলা আকাশে নিচে থাকছি। রাতে অর্ধপোড়া গোয়াল ঘরে আশ্রয় নিচ্ছি!
এই দম্পতি মতো ক্ষোভের আগুনে পুড়ে গেছে বাড়েদাপাড়ার নিরীহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৩ পরিবারের ১৮টি ঘরবাড়ির সর্বস্ব। অগ্নিসংযোগের আগে লুটপাট চলে এসব বাড়িতে। স্থানীয়রা জানান, উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘের লিজ নেয়ার জন্য ডহর মশিয়াহাটির বাড়েদাপাড়ার পিল্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান। সেখানে চুক্তিপত্র করা সময় গোলযোগ হলে অজ্ঞাত ৭/৮ দুর্বৃত্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছে কুপিয়ে ও গুলি করে তরিকুলকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর রাতে বিক্ষুব্ধ একদল লোক ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের অন্তত ১৮টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। এরপর পাড়াটির লোকজন ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেয় বিলে ঝোপ ঝাড়ে। এরপর দূর থেকে দেখতে পান তাদের বাড়ি ঘরে আগুন জ্বলছে। সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন ধানের গোলা, বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়লঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে, এই ঘটনার চারদিন পর সোমবার বিকেলে নিহত তরিকুল ইসলামের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু ১১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। এছাড়া বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। ঘটনার পর থেকে কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পাড়াটিতে। পুড়িয়ে দেয়া বাড়িগুলোতে নারী সদস্য থাকলেও তারা আতঙ্কিত। নতুন করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তরিকুল উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি ছিলেন।
সোমবার বিকালে সরেজমিনে পাড়াটিতে দেখা যায়, যতদূর চোখ যায়, চারিদিকে ঘরবাড়ির জিনিসপত্র পোড়া ছাই। কারোও বাড়ির ঘরের ইট আছে শুধু, ঘরের ছাউনি, তার ভিতরে জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে আছে।
পাড়াটিতে বেশির ভাগ বাড়ির পুরুষ শূন্য। দূরদূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনেরা দলবেঁধে খাবার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে আসছেন। পাড়াটিতে চারদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। প্রতিটি বাড়িতে উনুন ঝলেনি আজ অবধি। নিকট আত্মীয় স্বজনেরা কোন খাবার আনলে তারা খাবার পাচ্ছেন। নিরাপত্তা দিতে পাড়াটিতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝে মাঝে আসছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তারপরেও আতংক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের এই পাড়াটিতে। কয়েকদিন ধরে অবিরত বৃষ্টিতে ভোগান্তি বাড়িয়েছে ঠাঁই হারানো এসব মানুষের।
স্মৃতি বিশ্বাস নামে এক নারী জানান, ‘অসহায় জীবন যাপন করছি। ঘরে কিছু নেই যে শরীরে জড়াবো। রান্না করবো, জায়গা নেই। বৃষ্টিতে আশ্রয় নিচ্ছি গোয়াল ঘরে। তিনি জানান, ‘পুলিশ প্রশাসন আসলেও রাত হলে আতংক বাড়ে। এই বুঝি আবার হামলা হলো। প্রশাসন টাকা, টিন দিলেও কি আমাদের সেই সাজানো গোছানো সংসার ফিরো পাবো বলেও প্রশ্ন তোলেন এই নারী।
# ঘেরের বিরোধ নয়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে হত্যা বলছে পরিবার
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের বিল বোকড়ে তরিকুলের একটি মাছের ঘের ছিল। ঘেরটির জমির ইজারার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে তরিকুল ইসলাম মাছ চাষ করতে চেয়েছিলেন। অন্য আরেক ব্যক্তি ওই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে তরিকুল ইসলামের বিরোধ হয়। বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলামকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রথমে কুপিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ নিহতের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু। তিনি বলেন, ঘের নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব নেই। প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড মনে করলেও রাজনৈতিক কারণে এ হত্যাকাণ্ড। যেহেতু এটা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা। আমার ভাই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতিক উদ্দেশ্য করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয় পক্ষ বিষয়টি ঘুরিয়ে দিতে নিরীহ হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। তারপরেও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কৃষকদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টিএস আইয়ূব সোমবার ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নেন। এদিন তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খুলনা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ ঘটনা জানার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পুর্ণবাসনে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
# পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা নেই, জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা
বাড়েদাপাড়ায় পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২৪ ঘন্টা ওখানে পুলিশের একটি টিম অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন তারা। যেহেতু বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দল বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন, ফলে অবনতি হওয়ার আশাঙ্কা করছেন না বলে জানিয়েছেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দিপাঙ্কর দাস রতন। এছাড়া গত শনিবার ও রোববার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢেউ টিন, শাড়ি, লুঙ্গি ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
এ ঘটনা রাজনৈতিক কোনও ঘটনা নয় বলে দাবি অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে কিছু রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছি। আসামিদের দ্রুত আটকে অভিযান অব্যহত রয়েছে। এই ঘটনায় সোমবার বিকালে মামলা করেছেন। যেহেতু নিহতের পরিবারের সদস্যদের আসামিদের চিহ্নিত করতে দেরি হওয়ায় মামলা হতে দেরি হয়েছে। গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।’