বাংলার ভোর প্রতিবেদক
শনিবার বেলা সাড়ে ১২ টা। যশোর শহরের আরএন রোডের নতুন বাজারের পিছনে মশিয়ার পেন্টিং ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপটির সামনে চারটি মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ খোলা। কোনটির তেলের ট্যাংকি ছিদ্র আবার কোনটির ট্যাংকির ভিতরে ময়লা। কোনটির আবার ইঞ্জিনে ময়লা ঢুকে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ওয়ার্কশপটির মালিক মশিয়ার রহমান জানান, দিনে যে কয়েকটি মোটরসাইকেল মেরামত করেন; তার অধিকাংশই এখন তেলের ট্যাংকি ছিদ্র আবার কোনটি ট্যাংকির ভিতরে ময়লা। মূলত পেট্রোল পাম্পের ভেজাল এবং নিম্ন গ্রেডের জ্বালানি তেলের কারণেই এই অবস্থা। শুধু এই ওয়ার্কশপটি নয়; বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের বৃহৎ বাইক ও ইঞ্জিন যন্ত্রাংশ সার্ভিসিংয়ের স্থান যশোরের আরএন রোডের প্রতিটি দোকানে এই সমস্যা নিয়ে যানবাহনের মালিকেরা ধর্ণা দিচ্ছেন। কেউ কেউ খরচ বাঁচানোর জন্য মোটরসাইকেলের ট্যাংকির পরিবর্তে বোতলে তেল ভরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। অভিযোগ, জেলার অধিকাংশ পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভেজাল এবং নিম্ন গ্রেডের জ্বালানী তেল বিক্রি হচ্ছে। পরিমাপে কারচুপি ও নিম্ন গ্রেডের জ্বালানী ব্যবহার করে নানা রকমের যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ছে ভোক্তাদের যানবাহন। মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করা হলেও থামছে না এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড। জেলা শহর বাদেও উপজেলাগুলোতেও বিধি বহির্ভুতভাবে বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়াই যত্রতত্র খোলা বাজারে এসব ভেজাল জ্বালানি বিক্রি হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর শহরের গাড়িখানাস্থ তোফাজ্জল ফিলিং স্টেশন, নিউ মার্কেট রজনিগন্ধা, চাচড়া ফিলিং স্টেশন, ধর্মতলা সোনালী ফিলিং স্টেশন, মণিহার মোড়ের যাত্রিক ফিলিং স্টেশন, মনিরউদ্দিন ফিলিং স্টেশন, চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড়ের আইয়ুব ফিলিং স্টেশন, আকিজ ফিলিং স্টেশন, খাজুরা বাসস্ট্যান্ড শিশু হাসপাতালের উপশহর ফিলিং স্টেশনসহ শহরের অধিকাংশ তেল পাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিম্নমানের তেল সরবারহ করার। বাহাদুরপুর এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক অপু বলেন, আমি নিউ মার্কেট সংলগ্ন উপশহর ফিলিং স্টেশন থেকে নিয়মিত তেল নিয়ে থাকি। আমার বাইকের ট্যাংকি নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এই পাম্প থেকে ওজনে কম দেয়ার কোন অভিযোগ পাইনি। মাহাবুর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী জানান, খয়েরতলা, ধর্মতলা, গাড়িখানা ও মণিহার এলাকা থেকে নিয়মিত তেল নিয়ে থাকি। এক বছরের মধ্যে আমার নতুন গাড়ির ট্যাংকির বেহাল অবস্থা। বাধ্য হয়ে অকটেন ব্যবহার করছি। তবে সালমান আহমেদ নামে এক মোটরসাইকেল চালক বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে গাড়ি ব্যবহার করছি। তবে এখনকার তেলে ভেজাল হওয়াতে দ্রুত ইঞ্জিন এবং ট্যাংকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন তেলের কারণে ত বটেই গাড়িতে এখন নিম্নমানের প্লেনশিট ব্যবহারও একটি বড় কারণ। এ কারণে খুব দ্রুত ট্যাংকিতে জং ধরছে।’ শহরতলীর পাঁচবাড়িয়া এলাকার দাউদ হোসেন বলেন, ট্যাংক ফুটো হয়ে যাওয়ায় গাড়িতে বোতল ঝুলিয়ে তেল ভরে মোটরসাইকেল চালাচ্ছি।
শহরের মুজিব সড়ক এলাকার মোটরসাইকেল সাভিসিং সেন্টারের পরিচালক সজীব বলেন, ‘এখন প্রায় প্রতিটি গাড়ির ট্যাংকির সমস্যা। পাম্পগুলোতে ভেজাল তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। ভেজাল তেলের কারণে ইঞ্জিনও নষ্ট হচ্ছে। এতে মোটরসাইকেল চালকদের বাড়তি খরচ বাড়ছে। তিনি জানান, নির্ধারিত দরে জ্বালানীর দাম গ্রহণ করে বিক্রি করছে নিম্ন গ্রেডের জ্বালানি। যা ব্যবহার অনুপযোগী। বিকট দুর্গন্ধযুক্ত এসব জ্বালানি ব্যবহার করা গাড়ি বাসায় রাখাও দুরহ হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে যশোরের পাম্প থেকে ভেজাল তেলের রমরমা ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। পেট্রোল, ডিজেল থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এই তেল ব্যবহার করে অনেকের যানবাহন অল্প সময়ে বিকল হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন জ্বালানী তেল মাপেও কম দেয়া হয়। যখনই ভ্রাম্যমাণ আদালত ও প্রশাসন অভিযান চালায়; পাম্পগুলোর সমিতি অভিযানের প্রতিবাদে কর্মসূচি দিলে প্রশাসন কঠোরতা থেকে পিছু হটে।
গাড়িখানা এলাকায় তোফাজ্জল ফিলিং স্টেশনের দুজন কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের পাম্পে কোন ময়লা বা নকল তেল নাই। নিয়মিত পাম্পের ডিপো পরিস্কার করা হয়। যারা অভিযোগ করছে; তাদের অভিযোগ সত্য নয়। যাত্রীক পেট্রোল পাম্পের ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর জানান, তাদের পাম্প নিয়মিত পরিস্কার করা হয়। এমনকি বিএসটিআই পরীক্ষিত। কোম্পানি তেল দেয়; ফলে ভেজাল হওয়ার সম্ভবনা নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) যশোরের উপ পরিচালক প্রকৌশলী আসলাম শেখ জানান, ‘আমরা নিয়মিত তদারকি করি। ভেজাল তেল ও ওজনে পরিমাণ দেয়াতে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি জরিমানা করা হয়। ফিলিং স্টেশন নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

