হাসান আদিত্য
ফুলের রাজ্যখ্যাত যশোরের গদখালী পানিসারা। এ এলাকার হাড়িয়াদাড়া গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন। চলতি মৌসুমে দুই বিঘা জমিতে গাঁদা, সাড়ে চার বিঘা জমিতে রঙিন গ্লাডিউলাস, রজনীগন্ধা চাষ করেছিলেন। কিন্তু গেল জুলাই আগস্টের অতি বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায় তার ক্ষেত। পরে আবারও নতুন করে চারা রোপণের পর নিবিড় পরিচর্যায় তার জমিতে এখন ফুটেছে চোখ ধাঁধানো সব রঙিন ফুল। আর এই ফুল মহান বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে চড়া দামে বাজারে বিক্রি করে হাসি ফুটেছে তার। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ফুল চাষ করা এই কৃষক বলেন, ‘বাজারে এ সময়ে এমন ফুলের দাম থাকে না।
কিন্তু এবার সব ধরণের ফুলের দাম বেশি। মূলত বৃষ্টির কারণে মাঠে ফুল চাষাবাদ হয়েছে কম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। এমন দাম অব্যহত থাকলে বিগত সময়ের ক্ষতি কাটিয়ে লাভের মুখ দেখা যাবে বড় পরিসরে।’
যশোর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালীর ছোট্ট এ বাজার। সূর্য ওঠার আগেই প্রতিদিন চাষি, পাইকার ও মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠছে। পাইকারদের কেনা ফুল সকাল থেকেই বিভিন্ন পথের বাসের ছাদে স্তূপ করে সাজানো হচ্ছে, পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা-চট্টগ্রামের মত বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ভ্যান ভরে ফুল যাচ্ছে। বিজয় দিবসের আগের দিন অথ্যাৎ শনিবার আর রোববার ছিলো সবচেয়ে বড় হাট। প্রতিদিন ছোট হাট বসলেও ঢাকাসহ বৃহৎ জেলার বড় বড় পাইকাররা এসেছেন এই দুইদিন। রোববার সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ী ও চাষিদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে গদখালীর বাজার। এদিন প্রতিপিস গোলাপ ১২ থেকে ১৫ টাকা, রজনীগন্ধা ১০ টাকা, মানভেদে প্রতি পিস জারবেরা ফুল ১০-১৭ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা প্রতি পিস ২-৩ টাকা এবং গাঁদা প্রতি হাজার সাড়ে চার শ’ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যদিও শনিবারের চেয়ে রোববার প্রতিটি ফুলের দাম কিছুটা কম দাবি কৃষকদের।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে গাঁদা ফুল। এবার সর্বচ্চ বিক্রি হয়েছে সাতশ’ টাকা। যা বিগত সময়ে সাড়ে তিনশ’ টাকা চারশ’ টাকা পর্যন্ত পেয়েছে কৃষকেরা। ফুলচাষিরা জানিয়েছেন, মাস খানেক আগ থেকে বর্তমানে প্রতিটি ফুল দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। আসছে ১৩ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগ মুহূর্তে ফুলের দাম আরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মঞ্জুর হোসেন নামে ফুলচাষি বলেন, ‘এ বছর বৃষ্টিপাত দীর্ঘায়িত হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে এ বছর শীতকালীন ফুল চাষ বিলম্বিত হয়েছে। কিছু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানকে ঘিরে ফুলের চাহিদা বাড়ে। সে কারণে আমরা বিশেষ পরিচর্যায় উদ্যোগ গ্রহণ করি। বিলম্বে চাষাবাদের কারণে ফুলের উৎপাদন কম হলেও দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় লাভের আশা করছি।’
গদখালির ফুলচাষি সাইফুল ইসলাম এ বছর এক বিঘা জমিতে জারবেরা ও রজনীগন্ধার চাষ করেছেন। তিনি এ কৃষক শঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে ফুল চাষিদের জন্য সেটা কাল হয়ে দাঁড়ায়। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে অনুষ্ঠান বা জাতীয় দিবসগুলো জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন হয় না। তাই ক্রেতা পর্যায়ে আমাদের ফুলের চাহিদা ও বিক্রি কমে যায়। তারপরও বাজার ধরার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি, দিবসগুলোতে ফুলের দাম আরো বাড়বে।’
ফুলচাষি ও বিপণনে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি বছরের গ্রীষ্মে বেশ কয়েকবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে। সেই সঙ্গে বর্ষা ঘিরে ছিল দুই দফা অতিবৃষ্টির দাপট। এসব কারণে যশোরের গদখালির ফুলচাষিদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সে ক্ষতি কাটিয়ে দিন রাত একাকার করে পরিচর্যা করেছেন তারা। বিজয় দিবস উপলক্ষে এ বছর সব ধরনের ফুলের দাম বাড়তি। বাজার এমন চাঙ্গা থাকলে আগামি দিবসগুলোতে লাভবান হবেন বলে তারা আশাবাদী।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, বিজয় দিবস উপলক্ষে শনিবার ও রোববার দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। আগামী ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন, ইংরেজি খ্রিস্টীয় নববর্ষ, ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তবরণ উৎসব, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানকে লক্ষ্য করে মোটা অংকের ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে চাষিরা।
যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘গত দুই দিন দুই কোটি টাকার ফুল বিকিকিনি হয়েছে। দেশে বিভিন্ন উৎসবে যে পরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয়, তার ৭৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় যশোরে। তিনি বলেন, এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পর অসময়ে বৃষ্টিতে ফুলচাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চলতি বছর মৌসুমের চার মাসে গদখালি থেকে ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
উল্লেখ্য, কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরের প্রায় ৬ হাজার চাষি দেড় হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ১৫ ধরনের ফুলের চাষ করছেন।