কাজী নূর
“বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে” সুদূর ইউরোপে বসে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজের মাতৃভূমির প্রতি এমনই গভীর আবেগ অনুভব করেছিলেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তিনি ফিরেছিলেন বাংলায়।

তেমনি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অমোঘ টানে এবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহর থেকে নিজ পূর্বপুরুষের ভিটা যশোরে ফিরেছেন ১৫ বছর বয়সী তরুণী তেহজিব শামস। তিনি কেবল দেশে ফেরেননি, ফিরেছেন যশোরের শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ দর্শক হয়ে। মা-বাবা এবং নানাকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহভরে উপভোগ করেছেন শিল্পাঙ্গন যশোরের জনপ্রিয় নাটক ‘চম্পাবতীর পালা’।

দৈনিক বাংলার ভোর-এর সঙ্গে এক একান্ত আলাপচারিতায় তেহজিব ফ্রেঞ্চ এবং কিছুটা ভাঙা বাংলায় জানান, ছোট থেকে তিনি ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজি ভাষায় অভ্যস্ত। কিন্তু মা-বাবার মধ্যে কথোপকথনের সময় তিনি বাংলা ভাষার প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করতেন। তাদের সেই আলাপচারিতা তাকে আকৃষ্ট করলেও ভাষাটি শেখা বা জানার সুযোগ তিনি পাননি।

একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তেহজিব বলেন, মা-বাবা বাংলাদেশি হওয়া সত্বেও তার বাংলা শেখার সুযোগ কম। তবুও তিনি বাংলার প্রতি গভীর মমত্ব অনুভব করেন। সেই মমত্বের কারণেই তিনি বাংলাদেশের নদ-নদী, সাহিত্য-সংস্কৃতি, থিয়েটার, সিনেমা এবং বাঙালিয়ানা খাবার সম্পর্কে জানতে চান।

প্যারিসের চেয়ে আপন বাংলাদেশের প্রকৃতি
তেহজিবের মনে হয়েছে, ঝলমলে, তকতকে প্যারিসের চেয়েও বাংলাদেশের প্রকৃতি তাকে অনেক বেশি আপন করে নিয়েছে। মা-বাবার মুখে শোনা বাংলাদেশের গল্প তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে।

স্কুল থিয়েটারে অভ্যস্ত এই তরুণী এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, প্যারিসে তিনি নিয়মিত থিয়েটার উপভোগ করেন। তবে ভাষা পুরোপুরি না বুঝলেও বাংলাদেশের নাটক ‘চম্পাবতীর পালা’র কুশীলবদের অভিনয় তার হৃদয় গভীরভাবে ছুঁয়ে গেছে। তাঁর মতে, একচুয়ালী থিয়েটারের কোনো ভাষা নেই। অভিনয় দেখে সব বুঝে নিতে হয়।

ভাষা না জেনেও আবেগের গভীরতা অনুভব করার এই ক্ষমতা তেহজিবের শিল্পবোধকেই তুলে ধরে।

তেহজিব শামসের পিতা শাহেদ শামস জানান, তাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি যশোরে। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি দেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি প্যারিসে স্ত্রী মালেকা টগর এবং কন্যা তেহজিব শামসকে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কন্যার বাংলাদেশ ঘোরার ও শিকড়ের টান মেটানোর প্রবল আবদারেই তিনি সপরিবারে দেশে এসেছেন।

প্যারিসের আধুনিক জীবন ছেড়ে ১৫ বছরের তরুণীর এমন স্বতঃস্ফূর্ত মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো শতবর্ষ পূর্বের বাঙালির আত্মার টানকেই যেন নতুন করে জাগিয়ে তুলল।

Share.
Exit mobile version