শেখ জাফি
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দলের ‘বিতর্কিত’ নেতাকর্মীদের লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে যশোর জেলা বিএনপি। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে রুপ নিয়েছে। গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে দাপট দেখাতে মরিয়া দলের নেতাকর্মীদের একাংশ। তাদের দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে বিব্রত দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বারবার সতর্ক করেও সুফল মিলছে না। ফলে কমিটি স্থগিতের মত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে দলটির। তবে মাঠের রাজনীতিতে ভিন্নচিত্র জামায়াত ইসলামিতে। দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে মাঠের রাজনীতির বাইরে থাকা জামায়াত দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২০ মে ভেঙে দেয়া হয়েছিল যশোর জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটি। পরে ৫৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক কমিটিকে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে বলা হয়। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারেনি জেলা বিএনপি। আহ্বায়ক কমিটিতেই চলছে জেলা বিএনপির কার্যক্রম।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। আ.লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। যশোরের রাজপথ দখলে নেয় বিএনপি-জামায়াত। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দল ও নেতাদের ভাবর্মূতি আরও বাড়িয়ে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। তবে দলের হাইকমান্ডের এ আশা পূরণে ‘পথে কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন মাঠপর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী। তাদের দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না দলটি। গত তিন মাসে প্রায় একশ’ নেতাকর্মীকে বহিষ্কারসহ নানা সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না। জেলার বিভিন্ন স্থানে কতিপয় নেতাকর্মী দলের কঠোর অবস্থানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এ পরিস্থিতিতে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে দলটির জেলার নেতারা। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে লাগাম টানার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
অবশ্য বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের ‘জিরো টলারেন্সে’র কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কারণ অপকর্ম ও বিরোধে জড়িয়ে এরই মধ্যে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী দল থেকে বাদ পড়ছেন।
বিএনপির ৭৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত
একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকলেও প্রকাশ্যে বিরোধে জড়াতে ভয় পাচ্ছেন কেউ কেউ। আবার অনেকে নিজের এবং দলের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে ‘ গোপনীয়তা ও সর্তকতা’ অবলম্বনের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।
দলের জেলার নেতৃবৃন্দ মনে করেন, কয়কটি উপজেলায় মুষ্টিমেয় নেতাকর্মীর নেতিবাচক কাজের দায় দলের সবাইকে নিতে হচ্ছে। নানা কায়দায় যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সুবিধা নিয়েছেন এখনও তারাই চাঁদাবাজি ও দখলদারিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
জেলা বিএনপির তথ্যমতে, ৫ আগস্টের পর যশোরে বিএনপির ৭৫ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বহিষ্কার করা সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইউনুস আলী। অভিযোগের ভিত্তিতে সদর উপজেলা বিএনপি তাকে দলের প্রাথমিক সদস্য ও সংগঠনের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে। মনিরামপুর উপজেলার একজন ও কেশবপুর উপজেলার দুই বিএনপি নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই অভিযোগে কেশবপুর উপজেলা যুবদলের তিনজন। এছাড়া হামলা, হুমকি ভাঙচুরের ঘটনায় সদর মনিরামপুর ও কেশবপুরের চার ছাত্রদল নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন-অর-রশিদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিএনপি নেতা এ কে শরফুদ্দৌলা ওরফে ছোটলুকে ও যুবদল নেতা হাবিবুল্লাহকে দল থেকে বহিষ্কার।
পটরিবর্তনের পর ঘটেছে হত্যা কাণ্ডের মত ঘটনা। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলায় পিয়াল হাসান (২৮) নামে এক যুবদলকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৯ নভেম্বর দুপুরে ঝিকরগাছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভেতরে এ ঘটনা ঘটে।
স্বজনের অভিযোগ, স্থানীয় এক ছাত্রদল নেতা ও বিএনপির কর্মীরা তাঁকে খুন করে। তবে অভিযোগ হছে পিয়াল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসা মাহমুদের নেতৃত্বে চলাফেরা করত। এছাড়া ২৬ নভেম্বর যশোর শার্শায় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে ঘটছে বোমাবাজির ঘটনা।
এদিকে, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল (জামায়াত, ইসলামী ঐক্য জোট) যেখানে ভোটের মাঠ গোছাতে ব্যস্ত। জামায়াতের কোন নেতাকর্মী বহিস্কার হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজির অভিযোগও গণমাধ্যমে আসেনি।
এ বিষয়ে জেলা জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি প্রফেসর গোলাম কুদ্দুস বলেন, পটপরিবর্তনের পর দলে কোন নেতা বহিস্কার হয়নি। তবে সন্ত্রীদের হাতে এক নেতা খুন হয়েছে। বর্তমানে দলকে সুসংগঠিত করে সকল বিভেদ ভুলে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি চলছে।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, বিএনপি একটি বড় দল। তার পরেও চলমান পরিস্থিতিতে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ নেই। দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ৭৫ নেতাকর্মীকে পদ স্থগিত ও বহিষ্কার করা হয়েছে। যশোরের মনিরামপুর ও শার্শা এখনও কমিঠি গঠন হয়নি। বাকি উপজেলার ভোটের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রক্রিয়ার কমিঠি গঠন করা হয়েছে।
শার্শা ও মনিরামপুর কমিটি এখন গঠন না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই দুটি উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন কমিটি এখনও গঠন হয়নি। এ কারণে বিলম্ব হচ্ছে। দ্রুত এ কাজ শেষ করে আগামি ডিসম্বেরের শেষ সপ্তাহে কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠন করা হবে।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। কোনো অপকর্মে বিএনপি কর্মীদের নূন্যতম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি করতে গেলে তাকে পুলিশে দিতে বলেছি।’
বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে অনেক অপপ্রচার চলছে দাবি করে সাবেরুল হক সাবু বলেন, তিনি বলেন, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন প্রায় শেষ। চলমান আন্দোলনে মূল দল বিএনপির চেয়ে এসব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের যশোরেসহ সারা দেশে ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। পট পরিবর্র্তনের পর যশোর জেলা বিএনপি নেতারা অনেক উজ্জীবিত। তৃণমূলে সাংগঠনিক কমিটি গঠন চলছে। তৃণমূলে সাংগঠনিক কমিটি গঠন হওয়ায় দল আরও শক্তি শালী হয়েছে।’