বেনাপোল সংবাদদাতা
মারাত্মক অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। স্থলবন্দরেন অগ্নিনির্বাপণে নেই নিজস্ব সক্ষমতা। অকেজো অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জাম আর মাত্র ৬ জন ফায়ার কর্মী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে বন্দর ফায়ার স্টেশনের কার্যক্রম।
গত ৯ জুলাই বিকেলে বেনাপোল স্থলবন্দরের ফায়ার বিল্ডিংয়ের পণ্য লোডবাহী একটি দেশি ট্রাকে আগুন লাগলে দীর্ঘ সময়ে কোন ফায়ার কর্মী না আসায় বহিরাগত লোক ও বন্দরের লেবাররা মিলে অগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
জানা যায়, ঢাকা মেট্রো-ট-১৬-৯৫৭৭ একটি কাভার্ডভ্যান ট্রাক বন্দরের ১৭নং শেড থেকে ৩৯২ রোল ফেব্রিক্স লোড করে বন্দরের ফায়ার স্টেশনের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় আকস্মিক ট্রাকের ইঞ্জিনের সামনে আগুন ধরে যায়। ফায়ার স্টেশনের সামনে ঘটনাটি ঘটলেও কোন ফায়ার কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বন্দরের লেবার ও বহিরাগতরা মিলে আগুন নেভান। বারবার বন্দর এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেই। ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়না।
সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী আকবার আলী জানান, বন্দরের অব্যবস্থাপনায় বারবার অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হলেও বন্দরের কোনো দায়ভার নেই। অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও তা অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে প্রতিটি পণ্যাগার। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে আমদানিকৃত অতি দাহ্য পণ্যের সঙ্গে সাধারণ পণ্যও রাখা হচ্ছে। এতে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
বন্দরের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে বন্দরের ১০ নম্বরসহ ১০টি পণ্যাগারে আগুনে পুড়ে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, ২০০১ সালে ২৬ নম্বর পণ্যাগারে অগ্নিকান্ডে ক্ষতি হয় ৩০ কোটি টাকার, ২০০৫ সালে ১০ ও ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনের ঘটনায় ক্ষতি হয় ৭০ কোটি টাকা, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারিতে ৩৫ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা, একই বছরের ২২ জুন ২৭ নম্বর পণ্যাগারে আগুনে ক্ষতি হয় ১৫০ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ২ অক্টোবরে ২৩ নম্বর পণ্যাগারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৮ সালের ৬ জুন বন্দরের ভারতীয় ট্রাক টার্মিনালে ২৫ নম্বর শেডে আগুন ধরে এক ট্রাক পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায়। ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে অগ্নিকাণ্ড প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যায় এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৭ জুন বেনাপোল বন্দরের ৩৫ নম্বর পণ্যাগারের সামনে মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ব্লিচিং পাউডারবাহী ট্রাকে আগুন লেগে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ছোটখাটো আরো ৭ থেকে ১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এ বন্দরে।
বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রফতানি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, এক বছর যাবৎ বেনাপোল বন্দর পরিচালকের পদ শূন্য রয়েছে। আর বিশাল এই বন্দরে ফায়ার সার্ভিস কর্মী মাত্র ৬ জন যা খুবই নগণ্য। বন্দরের অবকাঠামো সহ আমদানিকারকদের পণ্যের নিশ্চয়তা প্রদানে বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যাপক উদাসীন। সেই সাথে রয়েছে পণ্যাগার সল্পতা। বর্তমানে বন্দরে আমদানি পণ্য রক্ষণাবেক্ষণে ৪৪টি পণ্যাগার, চারটি ওপেন ইয়ার্ড, একটি রফতানি টার্মিনাল, একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল ও একটি আমদানিকৃত গাড়ির চেসিস রাখার টার্মিনাল রয়েছে। সেখানে অগ্নি নির্বাপণের জন্য রয়েছে মাত্র ৬ জন কর্মী। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
আমদানিকারক বেলাল চৌধুরী জানান, গত নয় বছর আগে বেনাপোল বন্দরের পণ্যগুদামে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে ১৫ লাখ টাকার আমদানি পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমি বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণের আবেদন করলেও আজ পর্যন্ত কোনো টাকা পাইনি। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষ আগুনের কারণও তাকে জানায়নি।
আগুন নেভানোর বিষয়ে বেনাপোল বন্দরের ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহিনুর রহমানকে মুঠোফোনে কল করলে তিনি বলেন, আমি বন্দরের ফায়ারের কাজে যশোরে এসেছি আগুন লাগার সময় আমাদের লোকজন ছিলো। তিনি আরও জানান, আমাদের ফায়ার কর্মী সংখ্যা মাত্র ৪ জন আর আউটসোর্সিংয়ের আছে ২ জন মোট ৬জন। একটি আগুন লাগলে কমপক্ষে ১৬জন লোকের প্রয়োজন হয় বলে তিনি জানান। এতে দুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। কর্তৃপক্ষ লোক না নিলে আমি কি করবো। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও এখনও পর্যন্ত জনবল নিয়োগ হয়নি।
বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৪ বছরে বেনাপোল বন্দরের গোডাউনে বড় ধরনের ১৩ বার আগুন লেগেছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রতিবারই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগুন নিয়ন্ত্রণে বন্দরে যেসব সরঞ্জাম আছে সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, গোডাউনে অতি দাহ্য পণ্যের সঙ্গে সাধারণ পণ্যও রাখা হচ্ছে। এতে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে। বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা বাড়াতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
বন্দরটির উপপরিচালক রেজাউল করিম বর্তমানে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মে ধুঁকছে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্যক্রম। প্রসঙ্গত বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক পদ প্রায় এক বছর ধরে শূন্য রয়েছে। বন্দরটিতে দ্রুত পরিচালক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।