বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের দুঃখখ্যাত ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ৪ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দফায় দফায় অবিরাম বৃষ্টি, উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং হরিহর, শ্রীহরি, মুক্তেশ্বরী, টেকা ও ভদ্রা নদীর উপচে পড়া পানিতে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ফলে কেবশপুর, মণিরামপুর, অভয়নগরের শতাধিক গ্রামের প্রায় ৪ লাখ মানুষ তিন মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাড়িঘরে উঠে যাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষকে বিভিন্ন সড়ক, উঁচু স্থান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। যারা এখনো গ্রামাঞ্চলে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন, তারা গৃহপালিত পশু-পাখি, সাপ, পোকামাকড়ের সঙ্গে বসবাস করছেন। পানিবন্দি এলাকায় মানুষের খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ ও পানিবাহিত রোগে।
এমন পরিস্থিতিতে ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। রোববার বেলা ১২ টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অভয়নগরের আমডাঙ্গা খাল, সুন্দলী, বিল কপালিয়া ও ভবদহ স্লুইসগেট এলাকা পরিদর্শন ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। রিজওয়ানা হাসান যেখানে পরিদর্শনে যান; সেখানেই জলমগ্ন হয়ে ভোগান্তিতে থাকা এলাকাবাসী তাদের দীর্ঘদিনের দাবি নিয়ে বিভিন্ন বিলবোর্ড ও ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে অবস্থান করতে থাকেন। দ্রুত ভবদহবাসীর সমস্যা নিরসনের সঙ্গে বিগত সময়ে সমস্যা নিরসনের নামে প্রকল্প লুটপাটকারীদের শান্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পরিদর্শনকালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এতোদিন জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শে ভবদহ সমস্যা নিরসনের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এবার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবদহের স্থায়ী সমাধানের পথেই হাঁটব। পানি উন্নয়ন বোর্ড অথবা অন্য কোনো সংস্থা এবার নিজেদের মতামত আরোপ করবে না। জনগণের মতামত নিয়েই তারা পরিকল্পনা করেছে এবং সেটাই বাস্তবায়ন করা হবে। এ অঞ্চলের মানুষের ঋণ স্থগিতসহ বেশ কিছু সাহায্যের প্রয়োজন সে বিষয়ে আমি ইতিমধ্যে চিঠি করেছি। এবং ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ভবদহ নিয়ে অনেক প্রকল্প হয়েছে, সমস্যা কেন বার বার ফিরে আসে সেটা বিশ্লেষণ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভবদহ সমস্যা সমাধানে ভুক্তভোগী জনগণের চাওয়ার ভিত্তিতে আমডাঙ্গা খাল প্রশস্তকরণ ও এ এলাকার নদ-নদী খনন করা হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা, যশোরে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা, পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী প্রমুখ।
সরেজমিনে ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানি নিস্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্য হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নামছে না। এ অঞ্চলে যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। ক্ষেতের ফসল, ঘেরের মাছ সবই কেড়ে নিয়েছে এই পানি। কেড়ে নিয়েছে মানুষের থাকার জায়গাটুকুও। শতাধিক গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি এবং মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। পানির কাছে হেরে যাচ্ছে ভবদহ অঞ্চলের ৪ লাখ মানুষ। তাদের অনেকের ঠাঁই হয়েছে মহাসড়কের ধারে, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভিন্ন এলাকায়। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, চার দশকে ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি। তবে পানি সংগ্রাম কমিটির নেতাদের দাবি, চার দশকে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। যার সিংহভাগ লুটপাট হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের কোনো উপকার হয়নি। তাই দ্রুত পানি নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মশিয়াহাটি গ্রামের প্রকাশ মণ্ডল বলেন, ‘এখনো ঘরের মধ্যে জল ঢুকে পড়েছে। উঠোনে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। ঘর থেকে সাঁকো দিয়ে বের হচ্ছি। জল আর একটু বাড়লে বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় উঠতে হবে। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে।’
একই গ্রামের শিবপদ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার বাড়ির উঠোনে হাঁটুজল। প্রতিদিন জল বাড়ছে। গ্রামের ১৫৫টি বাড়ির মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া সব বাড়ির উঠানে ১ থেকে ৩ ফুট জল উঠেছে। বাড়ির কয়েকটি ঘরে জল উঠেছে। আর একটু বৃষ্টি হলে বাড়ি ছাড়তে হবে।’
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ভবদহ জলাবদ্ধতার কারণে চার দশকের বছরের বেশি সময় ধরে তারা ভুগছেন। বিশেষ করে বিগত সরকারের প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। বর্তমান সরকার আমডাঙা খাল সংস্কার ও টিআরএম বাস্তবায়ন করলে তারা স্থায়ীভাবে জলবদ্ধ মুক্ত হতে পারবেন।
এদিকে, ভবদহ এলাকা পানি সম্পদ উপদেষ্টার পরিদর্শনে জলাবদ্ধতার অবসানে আশার আলো দেখছেন দুর্ভোগের শিকার হওয়া মানুষেরা। তারা বলেছেন, রিজওয়ানা হাসান একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন; অন্যদিকে সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাসে ভুক্তভোগীরা হয়েছেন আশান্বিত।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, ‘এর আগে উপদেষ্টার নির্দেশে কিছুটা পানি নিস্কাশনের কাজ শুরু হয়েছে। এবার পানি সম্পদ উপদেষ্টা ও তার টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে। এতে আমরা আশার আলো দেখছি। তবে আমরা সরকারের কাছে এর সফল বাস্তবায়নের দাবি জানাই। আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। একই সাথে বিগত সরকারগুলোর নেয়া বিভিন্ন পরিকল্পের লুটপাটের তদন্ত করে জড়িতদের বিচার করতে হবে।’