বাংলার ভোর প্রতিবেদক
লাগামহীনভাবে সাবমারসিবল পাস্প বসিয়ে চলছে ভূগর্ভ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন। সরবরাহ লাইনে মোটর সংযোগ দিয়েও পানি টেনে নিয়ে ট্যাংকে ‘রিজার্ভ’ (সংরক্ষণ) করছেন বহুতল ভবনের মালিকেরা। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এরকম অনিয়মের কারণে পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত হচ্ছেন যশোর পৌরসভার নাগরিকদের বড় একটি অংশ। বছরের পর বছর ধরে এমনটি চললেও এটি বন্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে না পৌর কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞরা বলছেন, সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে ভূগর্ভের পানি যেভাবে তোলা হচ্ছে; সেভাবে পুনর্ভরনই হচ্ছে না। এতে মাটির তলদেশে পানির স্তর ক্রমশ অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে সুপেয় পানির সংকট সৃষ্টি হতে পারে। ঘটতে পারে মরুকরণ। পানিতে লবইাক্ততা, আয়রনের আধিক্য, আর্সেনিক দূষণ ও ভূমিধসসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও হতে পারে। তাদের ভাষ্য, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত এমনিতেই কমে গেছে। সেই সাথে যশোর অঞ্চলের নদ-নদীর বেশির ভাগ মৃত। জীবন্তগুলোতেও পানি প্রবাহ নেই। ফলে উত্তোলনের পর মাটির তলদেশে নতুন করে ‘ওয়াটার রিচার্জ’ (সঞ্চিত) হচ্ছে না। এতে ‘ওয়াটার টেবিল’ দিনকে দিন নিচের দিকে নামছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। গত এক দশকে যশোর পৌরসভার ১১ হাজার বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। পৌর শহরটির আয়তন ১৪ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের তুলনায় ১১ হাজার সাবমারসিবল পাম্প মাত্রাতিরিক্ত। এটি পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. কেএম দেলোয়ার হোসাইন বাংলার ভোরকে জানান, ১৪ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটারের একটি শহরে ১১ হাজার সাবমারসিবল পাম্প পরিমাণে অনেক বেশি। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। এতো পবশি পরিমাণ সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে ওই আয়তনের ভূমির তলদেশ থেকে পানি তোলা হয় বলে শুষ্ক মৌসুমে স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। এতে একপর্যায়ে পানির স্তর স্থায়ীভাবে নিচে নেমে যেতে পারে। আর এমনটি হলেÑ ‘অ্যাকুইফার’ অর্থাৎ তলদেশের স্তরের একটি অংশ; যেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়; সেখানে ‘স্যালাইনিটি ইনট্রুইশন’ হতে পারে। পুরোপুরি ভাবে লবণাক্ততা চলে আসতে পারে।
তিনি জানান, এমনটি ঘটেছে গোপালগঞ্জে। সেখানাকার পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় দেশিয় প্রজাতির অনেক মাছের আর অস্তিত্ব মিলছে না। এভাবে সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে পানি তুললে শুষ্ক মৌসুুমে পানির ঘাটতি আরো বৃদ্ধি ছাড়াও ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি নির্দেশিকা আছে। তাতে বলা আছে, পৌরসভা পানি সরবরাহ করলে পৌর পরিষদের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে পানি তোলা যাবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে পৌরসভার কোনো নজরদারি না থাকায় ১১ হাজারের চেয়েও বেশি সংখ্যক বাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে।
যশোর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে পানির গ্রাহক ১৫ হাজার। ওই সংখ্যক গ্রাহকের পরিবার পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ পানি ব্যবহার করেন। পৌরসভার পানি সরবরাহ শাখা সূত্র জানায়, প্রতিদিন পানির চাহিদা ২ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার লিটার। ওই পরিমাণ পানি উত্তোলনের জন্য ২৯টি পাম্প রয়েছে। চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন পানি তোলা হয় ২ কোটি ১১ লাখ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন ৩৩ লাখ লিটার পানির ঘাটতি থাকছে। শুষ্ক মৌসুমে ঘাটতি আরও বাড়ে।
অভিযোগ রয়েছে, ঘাটতির কারণে পানি সরবরাহ হয় কম। দিনের মধ্যে কয়েক দফা পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর মধ্যে যেটুকু সময় পানি সরবরাহ হয়; তার বেশির ভাগ বহুতল ভবনের মালিকেরা মোটরের মাধ্যমে টেনে নিয়ে ট্যাংকে ‘রিজার্ভ’ করেন। এতে যারা কেবলমাত্র পৌরসভার সরবরাহ করা পানির ওপর নির্ভরশীল; তারা ঠিকমতো পানি পান না। এক্ষেত্রে পানির গতি থাকে খুব ধীর; অনেক ক্ষেত্রে ‘ট্যাপ’ (কল) দিয়ে পানিই বের হয় না। বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলছে। কিন্তু এরকম অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পৌর কর্র্তৃপক্ষ।
শহরের চাঁচড়া রায়পাড়ার বাসিন্দা হেলেনা পারভীন বাংলার ভোরকে জানান, বহুতল ভবনের মালিকেরা পৌরসভার লাইনে মোটর সংযোগ দিয়ে পানি টেনে নিয়ে ট্যাংকে ভরছেন। এতে অন্যান্য বাসাবাড়ির লাইনে ঠিকমতো পানি আসছে না। আবার পানি আসলেও গতি অনেক ধীর; ‘ট্যাপ’ দিয়ে (কল) চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ে। এই অনিয়ম বন্ধ করা উচিত। বিল দিয়েও পানি পাচ্ছি না। অন্যরা আমাদের পানিতে ভাগ বসাচ্ছে। এতে পানির নায্য হিস্যা বঞ্চিত হচ্ছি। এদিকে, লাগামহীনভাবে সাবমারসিবল পাম্প বসানোয় ভূগর্ভে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পৌরসভার পাম্পগুলো দিয়েও ঠিকমতো পানি ওঠে না। সারাবছর এমনটি চললেও শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে। ওই সময় অনেক পাম্প অকেজো হয়ে যায়। পানির ঘাটতি দেখা দেয়।
যশোর পৌরসভা সূত্র জানায়, ৯টি ওয়ার্ডে ১২ হাজারের ওপর টিউবওয়েল আছে। খরার দিনে মাটির নিচের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব টিউবওয়েল অকেজো হয়ে যায়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বিএডিসির যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যশোরে পানির স্তর নিচে নেমেছিল ৩১ ফুট। আর ২০২০ ও ২০২১ সালে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমেছিল ২৫ ফুট। ২০২১ সালের শুমারি অনুযায়ী; যশোর পৌরসভায় বসবাস করেন ২ লাখ ৮৬ হাজার ১৬৩ জন মানুষ। হোল্ডিং অ্যাসেসমেন্ট অনুযায়ী; এই সংখ্যা ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৪। এরপর একযুগেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে জনসংখ্যা আরো বেড়েছে।
পৌরসভার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পৌরসভায় বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষের সুপেয় পানির প্রধান উৎস টিউবওয়েল। এরপর ঘরগৃহস্থালীর কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে পানির অন্যতম উৎস পৌরসভার ‘ওয়াটার সাপ্লাই’। কিন্তু নাগরিক সেবার এই সংস্থাটির সরবরাহ করা পানি পানের উপযোগী না। এতে কলেরা ও ডাইরিয়ার জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলেও অভিযোগ আছে। যার কারণে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের সবাই অবৈধভাবে সাবমারসিবল বসিয়ে পানি তুলে ব্যবহার করেন। আর তাদের বসানো সাবমারসিবলের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজারের ওপর।
পৌরসভার অনুমতি ব্যতীত সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন নিষিদ্ধ হলেও সামর্থ্যবান নাগরিকদের একটি অংশ এটি করলেও এতোদিন নিশ্চুপ ছিল পৌর কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি এ ব্যাপারে টনক নড়ায় একটি নোটিশ জারি করে বাসাবাড়িতে স্থাপন করা সাবমারসিবল পাম্প প্রতি মাসিক ৩শ’ টাকা বিল ধার্য করে প্রতিষ্ঠানটি। বিল নিয়ে এই অনিয়ম জায়েজ করার চেষ্টা চালান তৎকালীন পৌর মেয়র হায়দার গনি খান পলাশ। এ নিয়ে নাগরিকদের একটি অংশের আন্দোলনের মুখে সেটি বাতিলও করা হয়।
নিয়ম বহির্ভুতভাবে সাবমারসিবল পাম্প বসানো বন্ধ ও এর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন; এমন প্রশ্নে যশোর পৌরসভার পানি ও পয়োনিস্কাসন শাখার শাখার সহকারী প্রকৌশলী বিএম কামাল আহমেদ বাংলার ভোরকে বলেন, পানির মান ও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পর্যাপ্ত পরিমাণ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সাবমারসিবল বসানো ও সেটি দিয়ে পানি তোলা বন্ধ করা কঠিন।
তিনি বলেন, পানি শোধনের জন্য পৌরসভার তিনটি প্লান্ট আছে। সিটি কলেজ পাড়া, রেলগেট তেঁতুলতলায় ও পালবাড়ি এলাকায় পৌরসভার পাম্পে এই ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব প্লান্টে পানি শোধন করে সরবরাহ করাটা অনেক ব্যয়বহুল। শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হলে পানির যে পরিমাণ বিল ধার্য্য করতে হবে; সেটি অনেকে দিতে সমর্থ হবেন না।
নাগরিক আন্দোলনের নেতা ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য জিল্লুর রহমান ভিটু বাংলার ভোরকে বলেন, পানি ছাড়া এক মুহূর্তও চলা সম্ভব না। পৌরসভা যে পানি সরবরাহ করে সেটি পান ও রান্নার কাজের অনুপযোগী।
তিনি বলেন, ভূগর্ভের পানির বাইরে অন্য কোনো তেমন উৎস নেই। যার কারণে ভবিষ্যত ঝুঁকি জেনেও ভূগর্ভের পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ভূপৃষ্টের বিভিন্ন উৎসের পানি কীভাবে ব্যবহার করা যায়; রাষ্ট্রকে সেটি ভাবতে হবে।