হাসান আদিত্য
নদীর আধা কিলোমিটার অংশ দখল করে বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। আবার প্রতিষ্ঠান দুটিতে যাতায়াতের জন্য মাঝ বরাবর মাটি দিয়ে ভরাট করে সরু করা হয় নদী। সেই সরু নদীর মাঝখানে কংক্রিটের খুঁটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে লোহার ফুটওভারব্রিজ। সেতু ও হাসপাতালটি নির্মাণে নদীর এই অংশজুড়ে এমনভাবে দখল আর শাসন করা হয়েছে; বুঝার উপায় নেই এটিই এক সময়কার প্রমত্তা মুক্তেশ্বরী নদী। পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্তের সঙ্গে নালায় পরিণত হয়েছে। যশোর শহরের পুলেরহাটে নদী ও নদীর পাড় দখল করে নির্মিত বেসরকারি হাসপাতালটির নাম আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
শুধু অবরুদ্ধ আর দখলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এবার রীতিমতো নদীর টুঁটি চেপে ধরেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির মাঝখানে বাঁধ দিয়ে একাংশ শুকিয়ে কাটা হচ্ছে মাটি। সেই মাটি নদীর তীর দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠা বিভিন্ন স্থাপনার ভরাট ও সৌন্দর্যবর্ধণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবৈধভাবে নদী দখল আর নদী শুকিয়ে ফেলার চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটালেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ জেলা প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘মুক্তেশ্বরী নদী দখলের তালিকায় আদ্-দ্বীন হাসপাতালও রয়েছে। তাদের অংশে নদীর ০ দশমিক ৬১ একর বা ৬১ শতক দখলে রয়েছে। দ্রুতই দখলের নোটিশ পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, ‘নদী শুকিয়ে ফেলার ঘটনা জানা নেই। তবে হাসপাতালের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া অংশটুকু তারা ময়লা পরিস্কার করবে এমন একটি আবেদন করেছিলেন। তবে সেটি অনুমতি দেয়া হয়নি।’
ভৈরব নদের শাখা নদী মুক্তেশ্বরী যশোরের চৌগাছা দিয়ে মূল শহরে প্রবেশ করেছে। রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, যশোর-বেনাপোল আঞ্চলিক মহাসড়কের পুলেরহাট এলাকার সেতুর দক্ষিণ-পূর্ব কোনা থেকে নদী তীরে গড়ে উঠেছে পাঁচশ’ শয্যা আদ্-দ্বীন হাসপাতাল। নদীর তীরে প্রাচীর দেয়া হয়েছে। নদীর তীর দখল করে কংক্রিটের ঢালাই দেয়া হয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন ফল গাছ লাগানো হয়েছে। নদীরে পাড়েই হাঁস মুরগির বিভিন্ন ঘরও নির্মাণ করেছে আদ্-দ্বীন। নদীর ওপর আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত সখিনা মেডিকেল কলেজ ভবনে যাতায়াতের জন্য একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এই সেতুর দুই পাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে সরু করা হয়েছে নদী। নদীতে কংক্রিটের খুঁটি নির্মাণ করার জন্য নদীর মাঝখানেও ঢালাই করা হয়েছে। এতে পানি প্রবাহ বিঘ্ন ঘটছে। নদীর পূর্বপাশের অংশের নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাঁধ দিয়ে দুটি স্যালোমেশিন দিয়ে পানি শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। শুকানোর পর ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক সেই মাটি কেটে মেডিকেল কলেজের প্রাচীর বাঁধাইয়ের কাজ করতে দেখা গেছে। পর্যায়ক্রমে পশ্চিম অংশের পানিও শুকিয়ে মাটি কাটা হবে বলে জানিয়েছে শ্রমিকেরা।
পানি শুকিয়ে মাটি কাটার বিষয়ে আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ারের পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ‘ওখানে উন্মুক্ত মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হবে। সব সময় যাতে পানি থাকে সে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এ ধরনের কোন অনুমতি নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমরা নদী দখল করে ভবন নির্মাণ করিনি। ম্যাপে নদীর সীমানা নিরাপদ দূরত্বে রেখেই হাসপাতাল নির্মাণ করেছি। নদীর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্রিজের বিষয়ে বলেন, ওটা অস্থায়ী সেতু। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই নতুন ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। তবে এই ব্রিজ পানি প্রবাহে কোন সমস্যা করছে না বলে দাবি করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে মুক্তেশ্বরী নদীর অংশ দখল করে হাসপাতাল ও কলেজ নির্মাণ শুরু হয়। নদী ও পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘জরুরি উচ্ছেদ নোটিশ’ দেয়া হলেও বিগত সরকারের ছত্রছায়াতে নির্মাণ কাজ শুরু করেন আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ মহিউদ্দিন। তার ভাই যশোর -১ (শার্শা) আসনে আওয়ামী লীগের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন। ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ওই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করতে বেগ পেতে হয়নি মহিউদ্দিনকে। এমনকি হাসপাতাল নির্মাণের শুরু থেকে যশোর জেলা ও সদর উপজেলা প্রশাসন কয়েক দফা নির্মাণাধীন অবৈধ অবকাঠামো অপসারণের নোটিশ দিলেও তিনি বিষয়টি আমলে নেননি।
যশোর নদী সংস্কার আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘যখন নদী দখল করে হাসপাতাল নির্মাণ শুরু হয়; তখন থেকে আমরা আন্দোলন শুরু করি। অথচ যাদের সম্পদ তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি। প্রশাসনের শুধু তালিকা থাকলে তো হবে না; ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে হবে। আগেও ক্ষমতাধীন দলের ছত্রছায়াতে নদী দখল করেছে, এখনও তারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়াতে নদীর পানি শুকিয়ে মাটি কাটছে। প্রশাসন নদী রক্ষাতে কোন উদ্যোগ না নিলে নতুন কর্মসূচি নেয়ার হুশিয়ারি দেন তিনি।’