বাংলার ভোর ডেস্ক
অনেকদিন ধরেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে বাগে আনতে চাচ্ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। একাধিকবার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ঘায়েলের চেষ্টা এড়িয়ে যান কেজরিওয়াল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আর শেষ রক্ষা হলো না। আবগারি নীতি সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ এনেছে। এদিকে কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের পর দিল্লিতে বিজেপির সদরদপ্তরের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আম আদমি পার্টির সদস্যরা সেখানে ভাঙচুর করতে পারে, এমন শঙ্কা থেকেই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছি কিনা, তা জানায়নি বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের কয়েকদিন আগে কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় তার দল আম আদমি পার্টি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলটি বলেছে, কেজরিওয়াল “দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে তিনি কারাগার থেকেই সরকার পরিচালনা করবেন। তবে বিজেপি কেজরিওয়ালকে নৈতিকতার ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। এমন অবস্থায় এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেজরিওয়াল কি জেল থেকে সরকার চালাতে পারবেন?
ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের গভর্নররা সংবিধানের ৩৬১ অনুচ্ছেদ অনুসারে, তাদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা থেকে সাংবিধানিক সুরক্ষা ভোগ করেন। এই বিধানটি তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে গৃহীত যেকোনো পদক্ষেপের জন্য আইনি ঝামেলা থেকে রক্ষা করে। ভারতের সংবিধান অনুসারে, দেশটির সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। কিন্তু এই নিয়ম প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ফলে গ্রেপ্তারের কারণে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অযোগ্য ঘোষিত হন না।
একজন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে কারাগার থেকে কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করা বাস্তবিক দিক দিয়ে অতটা সহজ নয়। কিন্তু তা করার ক্ষেত্রে আইনি কোনও বাধা নেই। আইন অনুসারে, একজন মুখ্যমন্ত্রী কেবল কোনও মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেই তার পদ থেকে তাকে অপসারণ বা অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫১-এ নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের জন্য পদধারী ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করার জন্য অবশ্যই আদালতে দোষী সাব্যস্ত হতে হবে। একজন মুখ্যমন্ত্রীকে দুই পরিস্থিতিতে তার পদ থেকে অপসারণ করা যায়- যদি তিনি বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান, অথবা তার বিরুদ্ধে সফল অনাস্থা ভোট হয়। কিছু ক্ষেত্রে, গ্রেপ্তারের আগে বা পরে মুখ্যমন্ত্রীরা নিজে থেকেই পদত্যাগ করেছেন।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালই ভারতে পদে আসীন থাকা প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি গ্রেপ্তার হলেন। কারাগার থেকে তার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে। বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু যাদব যখন পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখন তিনি তার দায়িত্ব স্ত্রী রাবড়ি দেবীর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। গত ৩১ জানুয়ারি ইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন হেমন্ত সরেন। তার পদে পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার (জেএমএম) নেতা চম্পাই সরেন।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন এডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা। জেলেও যেতে হয়েছিল তাকে। তবে কর্নাটক হাই কোর্টের রায়ে খালাস পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে ২০১৫ সালে আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।
দিল্লি সরকারের মদ বিক্রেতাদের লাইসেন্স দেওয়ার নীতি (২০২১-২২) নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। তাদের মতে, এই নীতির ফলে কিছু বিক্রেতা একজোট হয়ে ব্যবসা করেছে এবং লাইসেন্স পেতে ঘুষ দিয়েছে। অবশ্য কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এই লাইসেন্স দেওয়ার নীতিটি পরে বাতিল করা হয়েছিল। দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি.কে স্যাক্সেনা এই নীতির বিষয়ে তদন্তের জন্য সিবিআইয়ের (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) কাছে আবেদন করেছিলেন। তদন্তের পর ইডি অর্থ পাচার রোধ আইনের আওতায় একটি মামলা করে। আবগারি দুর্নীতির এই মামলায় আম আদমি পার্টির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও দিল্লির সাবেক উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীষ শিশোদিয়া এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। দলটির আরেক নেতা সঞ্জয় সিংও একই মামলায় গত বছরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হন। এছাড়া তেলেঙ্গানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মেয়ে কে কবিতাকেও অতি সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়।
শেষবার পাঠানো সমনে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে বৃহস্পতিবারই ইডি দপ্তরে হাজিরা দিতে বলা হয়। কিন্তু তা না করে কেজরিওয়াল হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তবে হাইকোর্ট তার আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টে যান কেজরিওয়াল।
তবে হাইকোর্ট কেজরিওয়ালের আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পরই ইডি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ইডি কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হন কেজরিওয়ালের বাসভবনে, তল্লাাশি চালান তার বাড়িতে।
বাড়িতে ঘণ্টা দুয়েক তল্লাশি চালানোর পর কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে ইডি। শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে।