হাসান আদিত্য
সাধারণ পরিবারের সন্তান আজিজুল হাকিম তামিম। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হবেন। মা-বাবা পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে সন্তান ক্রিকেটে মেতে ওঠায় অনেকটা হতাশ ছিলেন। বাবা মায়ের চাওয়া ছিল, সন্তান পড়াশোনা করবে, ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে। কিন্তু ক্রিকেট খেলে এমন গৌরব অর্জন করবে, এটাই ভাবেননি তারা। একটি টিমের নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনা সন্তানদের জন্য মা-বাবা তো বটেই, গোটা দেশের মানুষ এখন খুশি। আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই। তামিম হলেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। তাঁর হাত ধরেই রোববার অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে টানা দ্বিতীয়বার এশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুললেন বাংলাদেশের যুবরা।
যশোর শহরের বারান্দিপাড়া এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষক মোহাম্মদ হুসাইন ও গৃহিনী সুলতানা পারভীন দম্পত্তির সন্তান তামিম। এই দম্পত্তির চার সন্তানের মধ্যে তামিম সবার ছোট। সে যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী।
যশোর শহরের বারান্দিপাড়া অম্বিকা বসু লেন সড়কের চারতলা ভবনের দ্বিতলায় স্বপরিবারে তামিমরা ভাড়া বাসাতে থাকেন। সোমবার দুপুরে তাদের বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশিরা ভিড় জমাচ্ছেন। তামিমেম এই সাফল্যে বাড়িতে ভিড় করে খোঁজ খবর নিচ্ছেন তামিমসহ গোটা পরিবারের। প্রিয় সন্তানের এমন অর্জনে বাড়ির সবাই বেশ আনন্দিত ও ফুরফুরে লক্ষ্য করা গেছে। তামিমের বাড়িতে যেয়েই শোকেসে দেখা গেছে ক্রিকেটার তামিমের নানা সাফল্যের সাক্ষি হওয়া ক্রেস্ট ও পুরস্কার। বাবা মোহাম্মদ হুসাইন সেগুলো দেখাচ্ছেন আর ছেলের সাফল্যের ডালা খুলে দিচ্ছেন। তবে তার এই অর্জনের পথটি মসৃণ ছিল না। ক্রিকেটর প্রতি একাগ্রতা আর ভালোবাসার কারণে সব প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব মঞ্চে। আর সে কারণেই তার এই সাফল্যে বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন এলাকাবাসীসহ গণমাধ্যমকর্মীরাও।
ক্রিইনফো তথ্য ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আজিজুল হাকিম তামিম ব্যাটিং অলরাউন্ডার। বাহাতে ব্যাট করেন এবং ডান হাতে অফস্পিন করেন। এশিয়া কাপের আগে ঘরের মাঠে আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। এই সিরিজে ওয়ানডেতে ৩-০ তে জয় পায় স্বাগতিকরা। এই সিরিজেও বাংলাদেশের নেতৃত্বে ছিলেন তামিম। এরপরই আলোচনায় উঠে আসেন এই ১৭ বছর বয়সী ক্রিকেটার। এরপর চলমান এশিয়া কাপ দিয়ে আরো আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাকান এই টপ অর্ডার ব্যাটার। পুরো টুর্নামেন্টে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনালেও তুলেছেন এই তরুণ। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন তামিম। ৪ ইনিংসে ১১২ গড় ও ৮৪.৮৫ স্ট্রাইক রেটে ২২৪ রান করেন তিনি। যেখানে একটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি দুটি হাফ-সেঞ্চুরি রয়েছে। সবমিলিয়ে ব্যাটিং-বোলিং-নেতৃত্ব সব বিভাগেই পারদর্শী তামিম। এই রিদম ধরে রাখতে পারলে আসন্ন ২০২৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারবে বাংলাদেশ।
তামিমের বাবা যশোর আমিনিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক ও নিবন্ধিত কাজী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘আমার চার ছেলে-মেয়ে। তার মধ্যে তামিম সবার ছোট। চারজনকেই লেখাপড়া শিখিয়েছি। তাদের মধ্যে তামিম ক্রিকেটার হয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। বাবা-মা হিসেবে এটা আমাদের জন্য বড় গর্বের। চার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার পাশাপাশি তামিমের ক্রিকেট সরঞ্জামের টাকার জোগান দেয়া অনেক কঠিন ছিল। ক্রিকেট খেলার সামগ্রির অনেক দাম। সব সময় ছেলেকে সেসব কিনে দিতে পারিনি।’
কথা বলতে বলতে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘একটা ব্যাটের জন্য তামিম বায়না করেছিল। তখন তাকে নিয়ে খেলাঘরে গেলাম। একটি ব্যাট ছেলে পছন্দ করল। ওই ব্যাটের দাম ছিল আট হাজার টাকা। তখন ওই টাকা আমার কাছে ছিল না। ছেলের চোখে পানি চলে আসে। তা দেখে বাকিতেই ব্যাটটি কিনে দিয়েছিলাম। পর আস্তে আস্তে ওই টাকা পরিশোধ করেছিলাম। সেই ছেলেই বছর সাতেকের মাথায় পুরো বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন আনন্দের এক উপলক্ষ। তিনি বলেন, ‘ছেলের ক্রিকেটের এমন নেশা হওয়াতে প্রথমে কিছুটা হতাশায় পড়ি। কি হবে ছেলের ক্যারিয়ার। পরে তার সাফল্য আর একাগ্রতা দেখে তার পিছনে টাকা খরচ করতে শুরু করি। তার কষ্ট আর দেশবাসীর দোয়াতে সে ভালো অবস্থানে গেছে।’
তামিমের ভাই আবু হুরাইরা বলেন, ‘তামিমের আদর্শ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। যদিও তাদের বাবার পছন্দের ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। এ জন্য ছেলের নামের রাখেন তামিম। তিনি বলেন, তামিম যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ঢাকার বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েও যেতে পারেননি তিনি। এর ফলে নিজ উদ্যোগেই খেলাধুলা চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। সে এমন খেলার প্রতি আসক্ত ছিলো তার কোন ফেসবুক নেই। বাসায় তার শোবার কক্ষে প্রাকটিস করতো। রাতে ঘুমানোর সময়ও তার কোলে কোলবালিসের পরিবর্তে ব্যাট জড়িয়ে ধরে থাকতো।’
তামিম সব বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলুক, তা কখনো চাননি তাঁর মা সুলতানা পারভীন। তিনি চেয়েছিলেন, ছেলে চিকিৎসক হয়ে গরিব-দুঃখী মানুষের সেবা করুক। তবে এখন তিনি ছেলের সাফল্যে গর্বিত। তিনি বলেন, ‘প্রথমে তারা খেলাধুলার জন্য চাহিদামতো সরঞ্জাম কিনে দিতে পারতাম না। পরে তার আগ্রহ দেখে ধার কষ্ট করে কিনে দিয়েছি। খেলাধুলা প্র্যাকটিসের প্রতি তার আগ্রহ বেশি ছিলো। রান্না দেরি হলেও দুপুরে না খেয়ে প্র্যাকটিসে যেতে। পরে তার ভাইকে দিয়ে মাঠে খাবার পাঠাতাম।
তিনি জানান, ‘ছেলে খেলা যখন টেলিভিশনে দেখতে বসি, তখন ঠিকমতো বসতে পারি না। এদিকে খেলা চলে ঘরে বসে ছেলে ও দলের জন্য দোয়া করি। আগে ক্রিকেট বুঝতাম না। ছেলের জন্য ক্রিকেট দেখে কিছুটা বুছি। আমার তামিম এখন বাংলাদেশের গর্ব; ছেলের সাফল্যে আমি গর্বিত। এখন স্বপ্ন দেখি, ছেলে জাতীয় দলে সুযোগ পাবে এবং বাংলাদেশের নেতৃত্বে দিয়ে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনবে।’
যশোর ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের পরিচালক ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বের্ডের যশোরের প্রশিক্ষক আজিজুম হক আজিম বলেন, ‘আমার ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে তামিমের ক্রিকেটের হাতেখড়ি। তামিম খুব ভালো খেলোয়াড়। তার সবচেয়ে ভালো গুণ হলো সে কথা শোনে এবং খেলার প্রতি মনোযোগী। সে একদিন ক্রিকেটের বড় তারকা হবে।’