বাংলার ভোর প্রতিবেদক
সাড়ে চার বছর যশোরের পুলিশ সুপার ছিলেন আনিসুর রহমান। বর্তমানে তিনি নৌ পুলিশের ডিআইজি। যশোরে দায়িত্বকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। বিএনপি-জামায়াত এমনকি আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতংক। খুন, গুম ও ক্রসফায়ারে হত্যা ও পঙ্গু করে দেয়া, দখল, নিয়োগ বাণিজ্যে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই চরম নির্যাতনের শিকার হতে হত। তার সাড়ে চার বছর ছিল বিভিষিকাময়। সেই দিনের স্মৃতি মনে পড়লে আজো আৎকে উঠেন ভুক্তভোগীরা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এসপি আনিসুর রহমানের নির্যাতন, হত্যা, গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা মুখ খুলছেন। ন্যায়বিচার বঞ্চিত অনেকেই আদালতের আশ্রয় নিচ্ছেন। ২৭ আগস্ট পর্যন্ত যশোরের আদালতে তার বিরুদ্ধে অন্তত ৪টি হত্যা ও গুমের অভিযোগে মামলা হয়েছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত যশোরের পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন আনিসুর রহমান। তার মেয়াদে অসংখ্য বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও পঙ্গু করা হয়েছে। দোদণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় তটস্থ থাকতেন সবশ্রেণির মানুষ। তৎকালীন এসপি আনিসুর রহমানের নির্মম নির্যাতনের প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মোটা অংকের টাকা নিয়েও অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যা ও পঙ্গু করে দিয়েছেন। ঘুষ ও দখল বাণিজ্য ছিল ওপেন সিক্রেট।
পুলিশের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যেও ছিলেন শীর্ষে। সীমান্তবর্তী জেলা যশোরের স্বর্ণ, মাদক ও ভারতীয় পণ্য চোরাচালানে আদায় করতেন কোটি কোটি টাকার হিস্যা। পুলিশ সুপারের পদে থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও তিনি পাত্তা দিতেন না। টেণ্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন তৎকালীন এসপি আনিসুর রহমান। তার দপ্তরেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে মারপিট করা হয়। তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই নেমে আসতো নির্যাতন ও হয়রানি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। অনেকেই মামলা দায়ের করছেন।
সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট যশোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যশোরের সাবেক পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান, কোতয়ালি থানার সাবেক ওসি শিকদার আক্কাস আলীসহ ৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিএনপি কর্মী মোহাম্মদ মাসুম গুমের অভিযোগ মামলা হয়েছে।
নিহত মাসুমের মামা কুদ্দুস আলী বলেন, ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরে সদর উপজেলার কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের বিএনপিকর্মী মোহাম্মদ মাসুমকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এসআই আবু আনসার সঙ্গীয় ফোর্স। এ সময় মাসুমের মামা মামলার বাদী আটকের কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়- ‘ও বড় নেতা হয়ে গেছে; ওকে মেরে ফেলা হবে’। পরের দিন থানায় গিয়ে তাকে হাজতে পাওয়া যায়। কিন্তু পুলিশ তাকে আদালতে সোপর্দ করেনি। ঘটনার ৯ বছর পর আদালতে মামলা করা হয়েছে।
গত ১৯ আগস্ট যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের পল্লিচিকিৎসক বজলুর রহমান ও আনিসুর রহমানকে বন্দুকযুদ্ধে নামে হত্যার অভিযোগে যশোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যশোরের সাবেক পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানসহ ৪৮ জনকে বিবাদী করে আদালতে দুটি মামলার আবেদন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর উপজেলার জয়পুর বাজারের পল্লিচিকিৎসক বজলুরকে তার দোকান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ওই রাতে বজলুরকে থানায় মারধরের পর গভীর রাতে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের বেগারিতলা এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
অন্যদিকে, ২০১৩ সালের ২২ মার্চ সকালে মনিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের ফজলুর রহমানকে পুলিশ বাড়ি থেকে আটক করে। এ সময় গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে ফজলুরকে উদ্ধার করতে গেলে মনিরামপুর থানার তৎকালীন ওসি আলী আজম খান জনগণকে লক্ষ্য করে গুলি করলে আনিসুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। এরমধ্যে গ্রামের বাসিন্দারা হামলার কথা মাইকে প্রচার করলে পুলিশ ও অন্য আসামিরা ফাঁকা গুলি করতে করতে পালিয়ে যায়।
গত ১৯ আগস্ট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের আবু সাঈদকে ‘ক্রসফায়ারে হত্যার’ অভিযোগে সাবেক এসপি আনিসুর রহমানসহ ৮ জনের নামে মামলা হয়েছে।
মামলার বাদি আবু সাঈদের স্ত্রী পারভীন খাতুন জানান, ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর উপজেলার জয়পুর বাজারের পল্লী চিকিৎসক বজলুর রহমানের দোকান থেকে আবু সাঈদকে আটক করে পুলিশ। এরপর তাকে মারপিট করে থানায় নিয়ে যায়। ওইদিন রাতে আবু সাঈদকে থানার ভেতরে মারপিট করা হয়। এরপর গভীর রাতে তাকে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের বেগারিতলা এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরের দিন সকালে পরিবারকে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। এরপর আসামিরা যোগসাজসে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত করে মরদেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পুলিশ হেফাজতে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে পরিবেশ অনুকূলে আসায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি আদালতে এই মামলা দায়ের করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এসপি আনিসের নির্যাতনের শিকার মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয়কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের দায়িত্বকালে যশোর জেলায় চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন হয়েছে। তার নির্দেশে খুন, গুম, ক্রসফায়ার পঙ্গু করা ও শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে পুলিশ। এসপি আনিসের নির্দেশে রাতের আঁধারে শহরের গাড়িখানা রোডের ৪০টি পরিবারকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও লুটপাট করে পুলিশ। এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করায় ২০১৭ সালে আমাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আমার ছেলেকেও মাদকের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে আমরা আদালতের মাধ্যমে মিথ্যা মামলায় মুক্তি পেয়েছি। তার সাড়ে ৪ বছরের অপকর্মের ফিরিস্তি বলে শেষ করা যাবে না।’