বাংলার ভোর প্রতিবেদক
শাস্ত্রীয় আচার আনুষ্ঠানিকতা ও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় শ্রী শ্রী শ্যামা পূজা ও দীপাবলি উৎসব উদ্যাপন করেছেন যশোরের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। পঞ্জিকা অনুযায়ী তিথি মতে সোমবার শহরের বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় আনন্দঘন পরিবেশে উৎসবটি পালন করা হয়। মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমা স্থাপন, অর্চনা, ভোগ নিবেদন, অঞ্জলি, আরতি, প্রসাদ বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যায় মন্দির জুড়ে আলোক প্রজ্বালন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শুরু হয়। কার্তিক মাসের অমাবশ্যা তিথিতে প্রতি বছর এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শক্তি ও শান্তির প্রতীক দেবী শ্যামা মায়ের আরাধনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে পূজার আয়োজন চলে, আর সর্বত্র বিরাজ করে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস।
দীপাবলি ও কালীপূজা উপলক্ষে যশোরে মন্দিরগুলো সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি মন্দিরের সামনে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। পূজার মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে ভক্তরা দেবী কালীর পূজা করছেন। প্রতিটি মন্দিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা প্রস্তুতি দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায় যশোরে দিপাবলী উৎসব আয়োজনের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উৎসবমুখর পরিবেশে পূজার আয়োজকরা এবার ব্যতিক্রমী সব আয়োজন করেছে। শ্রীশ্রী শ্যামাপূজায় প্রতিমা নির্মাণ শৈলী, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সদৃশ অস্থায়ী সুদৃশ্য মণ্ডপ, সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জায় এক নতুন মাত্রা এসেছে এবার। যশোর পৌর এলাকায় এবারও শতাধিক মন্দির ও মণ্ডপে দীপাবলী উৎসব ও শ্রীশ্রী শ্যামাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীপাবলী পূজায় আলোক প্রজ্জ্বলন করেন কলেজটির সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। এতে এমএম কলেজ ছাড়াও আশেপাশের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষও অংশ নেয়।
এদিকে, দীপাবলী উৎসব ও শ্যামাপূজা (কালীপূজা) উপলক্ষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। এদিকে শ্যামাপূজা উপলক্ষে মন্দির-মণ্ডপে আয়োজন হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠামালার।
যশোরে সহস্রাধিক প্রদীপ প্রজ্বালনে দীপাবলি উৎসব :
‘জ্বলে উঠুক আলোর সারি দূর হোক অন্ধকার, বিদায় নিক অশুভ বিজয়ী হোক শুভ শক্তি’ এই প্রতিপাদ্য স্লোগানকে সামনে রেখে যশোরে সহস্রাধিক প্রদীপ প্রজ্বালন উৎসব করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় দীপাবলি উপলক্ষে শহরের লালদিঘীতে পূজা উদযাপন পরিষদ যশোর পৌর শাখার আয়োজনে এই সহস্রাধিক প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়।
লাল দিঘীর পাড়ে সহস্র প্রদীপের আলোয় এক পবিত্র ও শান্তিময় আবহ তৈরি হয়। আলোর মালায় সজ্জিত এই প্রদীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনের সহ-অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী আত্মবিভানন্দজী মহারাজ।
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা দীপাবলির মহত্ত্ব ও গুরুত্ব তুলে ধরেন। তারা বলেন, এই উৎসব কেবল আলোর নয়, এটি অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ ও কল্যাণের প্রতীক। অতিথিরা মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনার পাশাপাশি সকল অশুভ শক্তি যেন বিনাশ হয়, সেই প্রার্থনা জানান।
অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ফ্রন্টের যশোর শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট দেবাশীষ দাস, সদস্য সচিব নির্মল কুমার বিট এবং সমাজ সেবক দেব্রত ঘোষ।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ যশোরের সভাপতি দীপংকর দাস রতন, সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার ঘোষ, পৌর শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মৃণাল কান্তি বসু, সম্পাদক উৎপল ঘোষ, দপ্তর সম্পাদক দেবাশীষ ঘোষ, অর্থ সম্পাদক নিরূপম বসু প্রমুখ।
সহস্রাধিক প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে যশোরের লাল দিঘীতে এক উৎসবমুখর ও ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে দীপাবলির শুভ সূচনা হয়। যা সকল অন্ধকার দূর করে শুভ শক্তির জয় ও মানুষের কল্যাণ কামনা করে। এদিন শহরের মাইকেল মধুসূদন কলেজসহ বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে দীপাবলি উপলক্ষে প্রদীপ প্রজ¦ালন করা হয়।
দীপাবলি :
শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করে। পরে লঙ্কায় গিয়ে রাবণ বধ করে বিজয়া দশমীতে। এরপর সীতাকে উদ্ধার করে ফেরেন অযোধ্যায়। ১৪ বছর বনবাসের পর সীতাকে সঙ্গে নিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ যখন অযোধ্যায় ফেরেন, প্রজারা তাদের এমন রাজকীয় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বিজয়ার পরবর্তী কার্তিক মাসের অমাবশ্যার দিনে ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দীপাবলি উৎসব পালন করেন।
হিন্দিবলয়ে এই উৎসবের নাম ‘দিওয়ালি’। দিওয়ালিতে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা হয়ে থাকে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে জানা যায়, আশ্বিন মাসের নরক চতুর্দশীর দিন ভগবান বিষ্ণু প্রবল পরাক্রমশালী নরাসুরকে বধ করেছিলেন। তার বধের মধ্য দিয়েই বসুন্ধরার সৃষ্টি। তাই এই বসুন্ধরার জন্মের তিথি উপলক্ষে গৃহস্থরা নিজ নিজ ঘরদোর সব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালন করে নতুনের আহবান জানানো হয়।
সারা উত্তর ও মধ্য ভারতজুড়ে যখন দিওয়ালি উৎসব পালিত হয়, বাঙালি সনাতন ধর্মাবম্বলীরা আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে কালীপূজা উদযাপন করেন। কালীপূজা মূলত অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করে শুভ শক্তির সাধনা। শুধু আলো জ্বালিয়েই উৎসবের উদযাপন শেষ হয় না। আতশবাজি পোড়ানোর ধুমও দেখা যায়। অশুভ শক্তি বিতাড়নের এটাও এক প্রাচীন আচার।
কালীপূজা :
জ্যোতির্বিদেরা মনে করেন, কার্তিক মাসের অমাবশ্যা বছরের সবচেয়ে তমশাঘন রাত। আকাশে হিমের পরশ পড়তে থাকে। এই ঘন আঁধার রাতেই নাকি ভূতপ্রেতরা নৃত্য করতে বেরিয়ে পড়ে। এমন দুই প্রেত, ডাকিনী ও যোগিনীকে দেখা যায় কালী মায়ের মূর্তির পাশে। পৌরাণিক মতে, এরা খুবই ভয়ংকর। তাই অশুভ শক্তি হিসেবে তারাও পূজিত হয় কালীমূর্তির সঙ্গে।
‘স্কন্দপুরাণ’ মতে দেখা যায়, দেবী চণ্ডী রক্তবীজ নিধন করার সূত্রে কালীমূর্তি ধারণ করেছিলেন। রক্তবীজের প্রতিটি রক্তফোঁটা থেকে অসুরের জন্ম হয়েছিল। শেষে চণ্ডী ভয়ংকরী হয়ে উঠে কালীমূর্তি ধারণ করে সমস্ত রক্ত পান করলে দানবকুলকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়। ‘স্কন্দপুরাণ’ ছাড়াও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিতে দেখা যায় শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন আদ্যাশক্তির কোষ থেকে উদ্ভূত দেবী কালী। কোষ থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে তাঁর আরেক পরিচয় ‘দেবী কৌশিকী’। কালীর অনেক রূপের কথা পুরাণে আছে। বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে তিনি করুণাময়ী, ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী নামে পূজিত হয়ে থাকেন। ইতিহাস বলে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মাধ্যমেই বাংলায় কালীপূজার প্রচলন শুরু হয়। সাধারণত গৃহস্থ বাড়িতে ব্রাহ্মণ্যমতে কালীপূজা সম্পন্ন হলেও বহু মন্দির এবং শ্মশানে তান্ত্রিক মতে তিনি পূজিত হন।

