♦ রাত দুইটার পরে বারবার ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে বের হন মিলন : ভাই
♦ গভীর রাতে দড়াটানায় চা পান করতে গিয়েছিল জুঁই : স্বামী
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
বুধবার দিবাগত রাত দুইটার পরে বার বার ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান মাসুদুর রহমান মিলন। একই সময়ে শহরের দড়াটানায় চা পান করতে যান আরিফিন আক্তার জুঁই। ভোর সাড়ে ৩টার দিকে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের নতুনহাট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কায় প্রাণ হারান প্রাইভেটে থাকা মিলন ও জুঁই। এতে আহত হন আরও দুইজন। দুই পরিবারের ভাষ্যে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, মাসুদুর রহমান মিলনের সঙ্গে আরিফিন আক্তার জুঁইয়ের সম্পর্ক কি ছিল? তারা কেন এত রাতে বেনাপোলের দিকে যাচ্ছিলেন। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এমন অনেক প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের যেসব উত্তর সামনে আসছে, সেটির ভিত্তি নিয়েও সংশয় রয়েছে। এ বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী তদন্ত করছে। বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে তাদের তদন্তে।
নিহত মাসুদুর রহমান মিলন যশোর শহরের স্টেডিয়ামপাড়ার বাসিন্দা ও যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। যুবমহিলা লীগ নেত্রী আরিফিন আক্তার জুঁই যশোর সদর উপজেলার সুজলপুর গ্রামের লিটন গাজীর স্ত্রী। আহতরা হলেন- সদর উপজেলার এড়েন্দা এলাকার মাসুদ রানা ও তার বন্ধু বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালি বেতাগা গ্রামের মামুন। এ ঘটনায় নিহত জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজী বৃহস্পতিবার নাভারণ হাইওয়ে থানায় অজ্ঞাত পিকআপ চালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
শুক্রবার সকালে মাসুদুর রহমান মিলনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। চলছে তাঁর মিলাদের আয়োজন। কথা হয় তার বড় ভাই হুমায়ন কবির মামুনের সাথে। তিনি জানান, ওই দিন রাত ২টার দিকে তার ছোট ভাই মিলন স্টেডিয়াম পাড়ায় তার নিজ বাড়িতে ফেরেন। বাড়ি ফেরার পর একের পর এক তার ফোনে কল আসতে থাকে। সে বাড়ি থেকে বের হতে চাচ্ছিলো না। পরে এক প্রকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে টাউজার পরা অবস্থায় বের হন।
এদিকে, আরেফিন আক্তার জুঁইয়ের বাবার বাড়ি উপশহরের সারথি মিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়িতেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ছোট সন্তান দুটো তার খালাদের সাথে রয়েছে।
নিহত জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজী বলেন, এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। হাইওয়ে থানায় অভিযোগ করেছি। যারা বেঁচে আছে ওদের ধরতে পারলে আসল ঘটনা বের হবে। ওই দিন রাত ২ টার পর মূলত চা খেতে দড়াটানায় যায় জুঁই। তারপর মাসুদ রানার সাথে দেখা হয়। তারা ঝিকরগাছায় অসুস্থ একজনকে দেখতে যাচ্ছিল। জুঁই ওদের সাথে যায়। গাড়ি চালাতে পারে কিনা দেখার জন্য মাসুদ ওকে গাড়ি চালাতে বলে। তারপর দুর্ঘটনা ঘটে।
জুঁইয়ের মা তাসলিমা খাতুন বলেন, স্কুলে পড়াশুনার সময় জুঁই অন্তর নামে একটা ছেলের সাথে প্রেম করে বিয়ে করে। পরে ২০১৬ সালে সুজলপুরের লিটন গাজী নামে একজনের সাথে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর তার মেয়ে একটু বেশি স্বাধীনভাবে চলাফেরা শুরু করে। ৮ থেকে ৯ মাস আগে নতুন বাড়ি বানিয়েছে। বাড়ি বানানোর আগে ভাড়া বাড়িতে থাকত তারা।
দুই পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, বারবার ফোন পেয়ে মিলন রাত দুইটার পর বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। একই সময় জুঁই দড়াটানায় চা খেতে গিয়ে মাসুদ রানার সঙ্গে দেখা হয়। তারা ঝিকরগাছায় অসুস্থ্য ব্যক্তিকে দেখতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মিলন, মাসুদ ও মামুনের সঙ্গে জুঁইয়ের সম্পর্ক কি ছিল? এতো রাতে তিনজন পুরুষের সঙ্গে জুঁই কেন গিয়েছিল। তাহলে তারা কি পরস্পরে ঘনিষ্ট ছিল?। জুঁইয়ের স্বামীর দায়ের করা মামলায় যদিও দাবি করা হয়েছে, পিছন থেকে পিকআপের ধাক্কায় প্রাইভেট আরোহী মিলন ও জুঁই নিহত হয়েছে। আর মিলনের সঙ্গে জুঁইয়ের ব্যবাসায়ীক অংশীদারিত্ব ছিল। তারা একসঙ্গে ব্যবসা করতেন। আসলে কি ব্যবসা করতেন, সেটিও মামলায় স্পষ্ট করা হয়নি। তাদের গভীর রাতে বেনাপোলমুখী হওয়া, দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘিরে নানা আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও তাদের অনুসারীদের অনেকেই বলছেন, মাসুদুর রহমান মিলন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুল ও সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের গ্রুপের রাজনীতি করতেন। শহরের একটি আবাসিক হোটেলে অবাধে নারী নিয়ে যাতায়াত ছিল তার। জরাজীর্ণ বাড়িতে থেকেও বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন মিলন।
এদিকে, জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজী বেশ কয়েকবার মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে পার্লারের ব্যবসার আঁড়ালে মাদক ও নারী ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। বেশ কিছু দিন ধরে লিটন ও তার স্ত্রীর চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। বিলাস বহুল গাড়িতে উঠতি বয়সি ছেলে সাথে নিয়ে চলাফেরা করত তারা। সোনা চালান করতে গিয়ে প্রভাবশালী অন্য সন্ত্রাসী গ্রুপের পিকআপের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছে বলে চাউর হয়েছে। তবে এ বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দুর্ঘটনায় আহত সদর উপজেলার এড়েন্দা এলাকার মাসুদ রানা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। তিনি কয়েকবার সোনাচোরাচালান করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। মাসুদ রানা সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নে সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। একই গ্রুপে রাজনীতি করার সুবাধে জুঁই, মিলন ও মাসুদের পরস্পরের সাথে পরিচয় ঘটে। এছাড়া আহত অন্যজন ফকিরহাট উপজেলার কাটাখালি বেতাগা গ্রামের মামুন। মামুন মূলত মাসুদের পূর্ব পরিচিত। তিনিও ওই এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়া ছিলেন। শক্তিশালী চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকেই।
এ বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে উঠে আসবে হত্যাকাণ্ড নাকি শুধু দুর্ঘটনা। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।