হাসান আদিত্য
যশোর শহরের বেজপাড়া রানার অফিস মোড়ে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট রাজনীতিক প্রতিপক্ষরা গুলি ও চাকু মেরে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান (৪৫)। এলাকায় বিচার সালিস করা, মাদক ও ছিনতাইবিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা, কাস্টমসের নিলাম ব্যবসা, এলাকায় রাজনীতিক আধিপত্যের দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার তিন দিন পর নিহতের ভাই মোর্শেদ আলী অজ্ঞাত ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশের তদন্তে হত্যাকাণ্ডে সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়। তবে অভিযুক্তরা সবাই জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের কর্মী হওয়ায় বিচার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার।
২০১০ সালের ১৪ মার্চ শহরতলীর রঘুরামপুর গ্রামে খুন হন সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন দাদা। জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে সহিংসতার ঘটনার জের ধরে দলীয় প্রতিপক্ষের লোকজন রিপনকে হত্যা করে। এই মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম। ২০১৪ সালের ৫ ফ্রেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট গৃহীত হয়। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিলেও এখন পর্যন্ত মামলার কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ বা বিচার শুরু হয়নি। মামলার এ দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী ও পরিবার।
স্বেচ্ছাসেবক লীগনেতা মান্নান কিংবা ছাত্রলীগনেতা রিপন নয়। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা থাকাকালীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। মূলত দলীয় কোন্দল, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, স্কুল, বিভিন্ন দপ্তরের কমিটির নেতৃত্ব না পাওয়ার কারণে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক ও অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে প্রবণতা বেশি যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ কারণে এই দুই সংগঠনের নেতা-কর্মী খুনের সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সদর ও শার্শা উপজেলায়। শার্শা ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সীমান্তে চোরাচালান, হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর সদরে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সঙ্গে এলাকায় আধিপত্যে বিস্তারের কারণে এই দুই উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিজ দলের নেতাকর্মীদের ইন্ধনে বেশির ভাগ নেতাকর্মী হত্যার শিকার হলেও এসব ঘটনায় করা মামলার একটিরও বিচার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার। উল্টো আসামিদের হুমকি ও চাপের মুখে রয়েছেন বাদীপক্ষ। তবে রাজনীতিক পট পরিবর্তনে নির্দলীয় সরকারের কাছে বিচার দাবি করছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। স্থানীয় নেতারাই বলছেন, বেশির ভাগ মামলায় খুনের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়। খুনের মামলার আসামিদের দলের পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে দলীয় মনোনয়নও। দলীয় শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপ থাকাতে প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
বিচার না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ নিহতের পরিবার:
হত্যার শিকার হওয়ার আগে একতলা বাসায় স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বেজপাড়া পিয়ারি মোহন রোড় এলাকাবাস বাস করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুল মান্নান। মান্নার হত্যার শিকার হওয়ার পরে আসামিদের প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়ার কারণে নিজ বাসা ছেড়ে অন্যত্র একটি ভাড়া বাসায় বসাবস করছেন নিহত মান্নানের স্ত্রী সাহিদা খাতুন দিপ্তীসহ তার সন্তানরা। বাসাটিতে শনিবার দুপুরে গিয়ে কথা হয় সাহিদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মান্নান যখন হত্যার শিকার হন তখন আমাদের তিন সন্তান ছোট। বেনাপোলের ছোট একটা ব্যবসা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। ব্যবসার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করতো। বেজপাড়া শান্তিশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতিও ছিলো। মান্নান বেজপাড়া শান্তিশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় এলাকায় কোনো সুবিধা করতে পারছিলো না স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ জন্য মান্নানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মান্নান হত্যাকাণ্ডের বিচারসম্পন্ন হয়নি এক দশকেও।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দুঃখ একটাই। যে দল করতো, সেই দলের নেতাকর্মীরা তাকে হত্যা করলো। দল এতোদিন ক্ষমতায় থেকেও বিচার পেলাম না। ওই সময় সব নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলো। কিন্ত বিচার পায়নি। বরং আসামিরা জামিনে বের হয়ে প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার সন্তানেরা তার বাবার হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখছে। নিজ দল তো বিচার করলো না, এখনই এই নির্দলীয় সরকারের কাছে বিচার দাবি করছি।’
মান্নানের শ্যালক আশরাফুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘মান্নান হত্যার ৭ আসামিই জামিনে। তারা সবাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রাজনীতি করে বলে বিচার প্রক্রিয়া থমকে আছে। বিভিন্ন সময়ে মামলা তুলে নিতে বোমা হামলা করেছে, পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে এসেছে।’
ছাত্রলীগনেতা রিপন হত্যার ১৪ বছর পার হলেও বিচার পায়নি তার পরিবার। সদরের রঘুরামপুর গ্রামের বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। মামলার বাদী রিপনের বড় ভাই সোহেল রানা তার মাকে নিয়ে ঝিনাইদহতে থাকেন। মুঠোফোনে সোহেল রানা বলেন, ‘ভাইয়ের বিচার নিয়ে ভাবি না। বিচার পাবো না জানি। দল ক্ষমতায় ছিলো দীর্ঘদিন। আবার দলের কর্মী ছিলেন রিপন। অথচ এই বিচারের জন্য দলীয়ভাবেও সহযোগিতা পায়নি। এক সময়ে বাবা এই মামলা চালাতেন, তিনি মারা গেছে দুই বছর হলো। তিনি ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেনি। মাও অসুস্থ, তিনিও দেখতে পারবেন না, আমিও পাবো না। আমার অসুস্থ মা নিরবে কাঁদে।’
২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চৌগাছার সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জিল্লুর রহমান মিন্টুকে দিনে দুপুরে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে। এঘটনাও দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নামে মামলা করা হয়েছে। এখনে সেই মামলার কোন বিচার পাননি নিহতের স্বজনেরা।
সদর ও শার্শাতে খুনাখুনি বেশি:
সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। যার জের ধরে এই দুই উপজেলায় খুন হয়েছে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদের অন্তত ৭০ নেতা। এরমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চার চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তরুণ লীগের নেতা রয়েছেন। সর্বশেষ খুন হয়েছেন চলতি বছরের গত ৯ জুন সদর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকার তেঁতুলতলা মোড়ে যুবলীগ কর্মী আলী হোসেনকে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় নিহতের মা আঞ্জু আরা বেগম বাদী হয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী নবাব হোসেনকে (৫৫) প্রধান আসামি করে ছয়জনের নাম উল্লেখ মামলা করেন। নেতাকর্মীরা জানান, আলী হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী ছিলেন। আর নবাব একসময়ে বিএনপির সঙ্গে রাজনীতি করলেও বর্তমানে তিনি স্থানীয় সংসদ নাবিল অনুসারীদের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। আলী ও নবাবের সঙ্গে স্থানীয় আধিপত্যে, বালিমহল ব্যবসার নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর আগে ২৪ মার্চ চূড়ামনকাটি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওরফে শিমুলকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, চূড়ামনকাঠি এলাকায় রাজনৈতিক দুটি পক্ষ সক্রিয় রয়েছে। জিল্লুর রহমান একটি পক্ষের অনুগত হিসেবে চলাফেরা করতেন। এ কারণে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে হত্যা করে।
অন্যদিকে, শার্শাতে গত এক যুগে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সীমান্তে চোরাচালান ও হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে যশোরের শার্শা উপজেলায় গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগের ৩৭ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর জের ধরে খুন হয়েছেন দলীয় কর্মীদের চার সন্তানও। এসব ঘটনায় করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। উল্টো আসামিদের হুমকি ও চাপের মুখে রয়েছে বাদীপক্ষ। বাদীপক্ষের অভিযোগ, অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের বেশির ভাগ যশোর-১ (শার্শা) আসনের সাবেক সংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের অনুসারী। শেখ আফিল টানা চার মেয়াদ ধরে সংসদ ছিলেন। আর আসামিরা এতোদিন ধরেই সংসদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিতেন। খুনের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান একজন, সাবেক চেয়ারম্যান একজন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ১০ জন, কৃষক লীগের একজন, সাংবাদিকসহ যুবলীগের ১৪ জন এবং ছাত্রলীগের ১১ জন নেতাকর্মী রয়েছেন। এসব ঘটনায় শার্শা থানায় ২৭টি ও বেনাপোল বন্দর থানায় ১৪টি মামলা হয়। পুলিশ জানায়, এই ৪১টি মামলায় অন্তত ২৫০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসামিদের কেউ কারাগারে নেই। সবাই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সদর উপজেলায় শাহীন-টিটো ও শাহীন-নাবিল গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন অন্তত ২০:
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সদরের রাজনীতিতে দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। একটির নেতৃত্ব দিতেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার অন্যটি তৎকালীন এমপি খালেদুর রহমান টিটো। রাজনীতিক দ্বন্দ্বে শহরে খুনাখুনি শুরু হয়। খালেদুর রহমান টিটোর এমপি পদ শেষ হলে সদরের রাজনীতিতে পট পরিবর্তন হয়। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নকে শুরু হয় শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিল নাবিল আহমেদের দ্বন্দ্ব। ১৫ বছরে শাহীন-টিটো শাহীন- নাবিল গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন অন্তত ২০ নেতাকর্মী হত্যা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। চলতি বছরের ২২ জুন সদরে হত্যার শিকার হন চুড়ামনকাটি ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওরফে শিমুল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, চুড়ামনকাটি এলাকায় রাজনৈতিক দুটি পক্ষ সক্রিয় রয়েছে। জিল্লুর রহমান একটি পক্ষের অনুগত হিসেবে চলাফেরা করতেন। এ কারণে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে হত্যা করেছে।
২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনকে (৫০) গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মোশারফ স্থানীয় এমপির অনুসারী ছিলেন। রাজনীতিক স্থানীয় আধিপত্যে জেরে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময় আফজাল শাহীনের অনুসারী হিসাবে রাজনীতি করলেও বর্তমানে তিনি নাবিলের সঙ্গে রাজনীতি করছেন। ২০১৪ সালের ২৫ মে রাতে শহরতলীর রাজারহাট চামড়ার বাজারে সদর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটোর অনুসারীরা সদর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের ওপর গুলি ও বোমা হামলা চালায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ দির পর যুবলীগ নেতা মারা যান। তবে হামলার রাতেই তিনি তৎকালীন এসপি আনিসুর রহমানের উপস্থিতিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লিয়াকত আলী শেখের কাছে হামলাকারীদের বিষয়ে জবানবন্দি দেন। তবে এই ঘটনায় কারোও বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি।
অভিযুক্তদের পদ পদবী দিয়ে পুরস্কৃত:
২০০৯ সালে বাগআঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুকে হত্যা করা হয়। মামলার প্রধান আসামি ইলিয়াস কবির বকুল। সাবেক এমপি শেখ আফিল উদ্দিন ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। এরপর ২০১৩ সালে ইলিয়াস কবিরকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদেও বসান। ২০১৬ সালে তাকে আবারও চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে সহায়তা করেন। পরে স্থানীয় বাজার কমিটির সভাপতিও হয়েছেন তিনি। বেনাপোল পৌর আওয়ামী লীগ নেতা ইবাদত হোসেন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও একই সুবিধা পেয়েছেন। এই মামলার তদন্তে নাম এসেছে স্থানীয় জুলফিকার আলী ওরফে মন্টু, মো. ওয়াহিদুজ্জামান ও মাহতাবের। এমপি আফিল তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এমপি ২০১৭ সালে জুলফিকারকে বেনাপোল স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, ওয়াহিদুজ্জামানকে যশোর জেলা পরিষদের সদস্য পরবর্তীকে পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসাস।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, শার্শায় সরকারি দলের রাজনীতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্বে আছেন স্থানীয় সাবেক এমপি আফিল উদ্দিন, অপর অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ আশরাফুল আলম। এই দুপক্ষের নেতৃত্ব দ্বন্দ্ব ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও বেনাপোল পোর্ট নিয়ে প্রায় ঘটে খুনোখুনি ও সংঘর্ষের ঘটনা।
একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব নিয়ে অনেক পরিচিত প্রভাবশালী নেতাকর্মী জনপ্রতিনিধি হত্যার শিকার হয়েছে। এতো সংখ্যাক নেতাকর্মী হত্যার শিকার হলেও এসব ঘটনায় করা মামলার একটিরও বিচার হয়নি। কারণ বেশির ভাগ হত্যা রাজনৈতিক। যিনি খুন হয়েছেন, সে কোন না কোন ভাই লীগের কর্মী। যারা হত্যা করেছে, তারাও কোন না কোন ভাইয়ের কর্মী। আসামিদের হুমকি ও চাপের মুখে রয়েছে বাদীপক্ষ। অভিযুক্তদের পদ পদবীও দেওয়া হয়েছে।
বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপ প্রধান মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম। তিনি জেলা জাসদের সভাপতি। একই সাথে জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যকরি সভাপতিও। তিনি বলেন, ‘খুন খারাপির কোন দল নেই, ধর্ম নেই। যেই করবে সেই অপরাধী। হত্যাকারী যে দলের হোক না কেন, তার বিচার হতে হবে। বিচার না হলে হত্যার প্রবণনতা বৃদ্ধি পাবে। আইনশৃঙ্খলা ভালো না থাকলে জনজীবনেও স্বস্তি থাকে না। এভাবে যদি হত্যা খুন রাজনৈতিক সহিংসতা হতে থাকে, জনজীবনে স্বস্তি বিনষ্ট হবে। সুতরাং যে মার্ডার হোক, যেই করুক দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এসে শান্তি দেওয়া দরকার।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘এক সময়ে দলীয় কোন্দলে অনেক হত্যা হয়েছে। তবে এটা অনেক কমেছে। খুনোখুনি এখনও হচ্ছে, তবে দলের কোনো বিষয়ে নয়। খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে নিজেদের স্বার্থে, ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে। যারা জড়িত, তারা সন্ত্রাসী। এসব মামলায় অনেক নেতাকর্মীদের নাম আসে। তারা বের হয়েও এসেছে। সেটা আইনের ব্যাপার, দলের কোন ভূমিকা নাই। আর দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়। পদ পদবী দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু তারা আদালতে প্রমাণিত হয়নি। তাই তারা পদ পদবী পেয়েছেন।’
এই বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘মামলার বাদীরা অনেক কিছুই অভিযোগ করে। মামলার অভিযোগে তদন্তে হত্যাকান্ডে জড়িতদের পুলিশ আটক করে আদালতে পাঠায়। পরবর্তীতে তদন্ত করে চার্জশিট দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এর পর আদালত অভিযুক্তদের বিচার করে। সব কয়েকটি ঘটনায় অভিযুক্তদের আটক করেছে পুলিশ। তবে এখন তেমন রাজনীতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’