স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
যশোরের আব্দুলপুর গ্রাম দীর্ঘদিন ধরেই সারা দেশে শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত। বিশেষ করে এই গ্রামে চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কয়েকশ’ কৃষক বছরের পর বছর চারা উৎপাদনকে প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা নিজেরা শীতকালীন সবজি ফলান না; বরং নিবিড় পরিচর্যা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বীজতলা প্রস্তুত, বীজ অঙ্কুরোদগম ও মানসম্মত চারা উৎপাদনের মাধ্যমে প্রতিবছর কোটি টাকার ব্যবসা করেন।

এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বেগুন এবং মরিচের চারা। কৃষকরা জানান, বিশেষ ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত এসব চারার মান এতই ভালো যে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিপুল পরিমাণ চারা পাঠানো সম্ভব হয়। এবছর প্রায় ৩০ কোটি চারা উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যার বাজারমূল্য ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকারও বেশি।

আব্দুলপুর গ্রামের দু’পাশে অবস্থিত রাস্তা ধরে হাঁটলে চোখে পড়ে শত শত পলিথিনে ঢাকা বীজতলা। আষাঢ় মাস থেকে কৃষকেরা জমি প্রস্তুত করে শুরু করেন বীজ বপন। প্রতিটি বীজতলার মাটি আলাদা ভাবে প্রস্তুত করা হয়, যাতে চারা দ্রুত ও সমানভাবে গজাতে পারে। বীজতলায় চারাগাছ এক মাস বয়স হলে তা তুলে দেশজুড়ে পাইকার ও খুচরা কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়।

বর্তমানে মান ও জাতভেদে চারা বিক্রির দামও ভিন্ন। বাজারে প্রতি হাজার ফুলকপির চারা বিক্রি হচ্ছে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায়; বাঁধাকপির চারা ৫শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। টমেটো ও বেগুনের চারা পাওয়া যাচ্ছে প্রতি হাজার ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায়। এছাড়া অন্যান্য সবজির চারা প্রতি পিস ১ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে কৃষকেরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার চারার দাম কিছুটা কম, ফলে লাভের পরিমাণও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের শীতকালীন সবজির চারা উৎপাদন করছেন। ছয় মাসে এই জমিতে চারা উৎপাদনে তার খরচ হয় প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তার হিসাব অনুযায়ী, এই জমি থেকে ৬০ থেকে ৭০ লাখ চারা উৎপাদন সম্ভব, যার বিক্রি হবে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। একই পরিস্থিতির মুখোমুখি এলাকার বেশিরভাগ চাষিই।

কৃষক ইলিয়াস আলী বলেন, তারা অনেকেই জমি বর্গা নিয়ে বছরজুড়ে চারা উৎপাদন করেন। সার, কিটনাশক ও শ্রমিকদের বাড়তি খরচের কারণে লাভ কমলেও তারা এই পেশায় সন্তুষ্ট। কারণ অনলাইনে অর্ডারসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত চারা পাঠানো যায়, ফলে বাজার সবসময় সচল থাকে।

প্রতিবছর ঝিকরগাছা, গদখালী, নাভারণ, চৌগাছা, মণিরামপুর ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, লোহাগড়া ও সাতক্ষীরার কৃষকেরা এখান থেকে মানসম্মত চারা কিনে নিয়ে যান।

চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা কৃষক আব্দুল লতিফ বলেন, “আব্দুলপুরের কৃষকেরা যেভাবে যত্ন নিয়ে কপির চারা উৎপাদন করেন, তা অন্য অনেক জায়গায় পাওয়া যায় না। দামও তুলনামূলক কম, তাই প্রতিবছর এখান থেকেই চারা কিনি।”

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক প্রতাপ মন্ডল জানান, মানসম্মত চারা উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কারিগরি দিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যশোরে মোট ৪০ বিঘা জমিতে বীজ রোপণ করা হয়, যেখান থেকে প্রায় ৩০ কোটি চারা উৎপাদন সম্ভব। এসব চারার বাজারমূল্য বর্তমানে প্রায় ২৫ কোটি টাকা—যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version