হাসান আদিত্য
প্রায় চার বছর আগে উৎসবমুখর পরিবেশে ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মোহিত কুমার নাথ। আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শাহারুল ইসলাম। দুই সদস্যের এই কমিটির মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আজও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। শুধু সদর উপজেলা নয়, যশোরের ৫টি উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ তো হয়ইনি, বরং মেয়াদউর্ত্তীণ শীর্ষ নেতৃত্ব দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। মণিরামপুর, ঝিকরগাছা, অভয়নগর ও বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটিতে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। সম্প্রতি জেলা সভাপতির একতরফা স্বাক্ষরে এসব ‘পকেট কমিটি’ ঘোষণা হলেও সেটি বাতিল করে কেন্দ্রীয় কমিটি।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ‘সভাপতি-সম্পাদকের একক সিদ্ধান্ত আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহারে দলে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। সভা সমাবেশে শীর্ষ দুই নেতার বলায় ঠিক রাখতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে অনুপ্রবেশকারীদের প্রধান্য দেয়ায় দীর্ঘদিনের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা অনেকেই আজ দিনকে দিন হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়েছেন।
৯৪ সদস্যবিশিষ্ট জেলা কমিটি হলেও গ্রুপিং দ্বন্দ্বে দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত হন গুটি কয়েকজন। এর মধ্যে সদ্য শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র কওে জেলা-উপজেলায় খন্ড খন্ড গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে আজ রোববার যশোরে উদযাপিত হবেআওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে উপলক্ষে বেলা ১২ টায় শহরের বকুলতলাস্থ বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বিকেলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রুপিং দ্বন্দ্বের কারণে জেলা আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিবেন না একটি অংশ। উপজেলা নির্বাচন ও পূর্বের দ্বন্দ্বের জেরে পৃথক পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবেন তারা।
জানা যায়, যশোরের ৮ উপজেলার মধ্যে ৫টিতে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। বিভিন্ন সময়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার উদ্যোগ নেয়া হলেও কোন্দলের কারণে ভেস্তে গেছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর সদর উপজেলা ও যশোর পৌর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মোহিত কুমার নাথ সভাপতি ও শাহারুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের মেয়াদ প্রায় তিন বছর হলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ২০১৪ সালে ২৮ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে কাজী মাহমুদুল হাসানকে সভাপতি ও গোলাম মোস্তফাকে সাধারণ সম্পাদক করে ২ সদস্যবিশিষ্ট মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার আগেই ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর গোলাম মোস্তফা মারা যান।
এরপর ২০১৮ সালের ১০ মার্চ কাজী মাহমুদুল হাসানকে সভাপতি ও প্রভাষক ফারুক হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জাহাঙ্গীর আলম মুকুলকে সভাপতি ও মুছা মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে রণজিত কুমার রায় এমপিকে সভাপতি ও হাসান আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এনামুল হক বাবুল সভাপতি ও সরদার অলিয়ার রহমান সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। এদিকে, গত ৩১ জুলাই যশোর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির একতরফা স্বাক্ষরে ঘোষিত মণিরামপুর, ঝিকরগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ‘পকেট কমিটি প্রকাশ হয়।
যেখানে স্বাক্ষর ছিল না জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে নানা বিতর্ক। পরে দলের ধানমণ্ডির কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের আহুত জরুরি সভায় ‘একতরফা’ ওই কমিটি বাতিল করা হয়। দীর্ঘদিনেও উপজেলা কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় পদপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কতিপয় নেতার আধিপত্যে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
জেলা আওয়ামী লীগের এক সহসভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতারা জেলার সভাপতি-সম্পাদকদের উপজেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে দিতে নির্দেশনা দিয়েছে। তার পরেও একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করছেন না তারা। এসব বিষয়ে দলের এই দুই শীর্ষ নেতা উদ্যোগ না নিলে কিভাবে কমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ হবে। জেলার সভাপতি-সম্পাদকের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জেলা ও উপজেলা নেতাদের মধ্যে বেড়েছে গ্রুপিং। একই সাথে তাদের ব্যর্থতায় তৃণমূল ঢেলে সাজাতে না পারায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হচ্ছে জেলার সংগঠনগুলো।
এ বিষয়ে মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে। আমরা ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করতে পারছি না। একই সাথে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলে দলীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হতো। দলের কার্যক্রম আরও গতিশীল হতো।
এ প্রসঙ্গে অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এনামুল হক বাবুল এমপি বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন না হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশ তৈরি হচ্ছে সঠিক। কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলে নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা বাড়তো। সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছি। অনেক ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করছি।
এ বিষয়ে যশোর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশনা রয়েছে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হলে স্থানীয় এমপি, জেলা ও উপজেলার সভাপতি-সম্পাদক সাথে নিয়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে। কিন্তু কাউকে একজায়গায় করতে না পারায় কমিটি পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না। উপজেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় তৃণমূলের কমিটিও পুর্ণগঠন করতে পারছি না। জেলার সম্পাদক শাহীন ও স্থানীয় এমপি নাবিলের একক সিদ্ধান্ত আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহারে দলে সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। সভা সমাবেশে শীর্ষ দুই নেতার বলয় ঠিক রাখতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে অনুপ্রবেশকারীদের প্রধান্য দেয়ায় দীর্ঘদিনের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা অনেকেই আজ দিনকে দিন হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়েছেন।
জেলা আ.লীগে বিভাজন, অনেক নেতা নিস্ক্রিয়:
৭৫ সদস্যবিশিষ্ট যশোর জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি। উপদেষ্টা পরিষদ আরও ১৯ জনের। ৯৪ সদস্যের বিশাল বহরের কমিটি। কিন্তু দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত হন গুটি কয়েকজন। বেশির ভাগ নেতা অনুপস্থিত থাকায় বিভিন্ন সভা সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক। এমনকি তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কমিটি দেয়ার দাবিও জানান।
২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে শহিদুল ইসলামকে সভাপতি ও শাহীন চাকলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ২২ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্মেলনের প্রায় দু’বছর পর জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদন দেয়া ১৯ উপদেষ্টাসহ ৯৪ সদস্যের এই কমিটিতে তরুণ ও সাবেক ছাত্রনেতারা স্থান করে নেয়। বাদ পড়ে আগের কমিটির অনেক সিনিয়র নেতারা।
কমিটিতে সভাপতি মিলনের পাশাপাশি যুক্ত হয় তার ছেলে, ভায়রা ও শ্যালক। যশোরের রাজনীতিতে অচেনা অনেকেও ঠাঁই পায়। এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে নেই জেলার রাজনীতির কোনো সম্পর্ক। নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, যশোর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যত দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটির নেতৃত্বে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার অপরটি সদরের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। সভাপতি শহিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য নাবিলের অনুসারী থাকলেও সম্প্রতি তিনি শাহীনের সঙ্গে রাজনীতি করছেন। গ্রুপিং বিভক্তিতে দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরাও বিভক্ত। ফলে সভা সমাবেশে গ্রুপিংয়ের নেতৃত্ব দেয়া শীর্ষ নেতারা উপস্থিত না থাকলে সেই গ্রুপিংয়ের নেতাকর্মীরাও অংশ নেয় না। গুটি কয়েকজন নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে কর্মসূচি শেষ হয়। আবার এই গ্রুপিং শীর্ষ নেতাদের বলায় ঠিক রাখতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে অনুপ্রবেশকারীদের প্রধান্য দেয়াতে অনেকেই দিনকে দিন হতাশায় ক্ষোভে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
নেতাকর্মীরা বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে আসেন না সহসভাপতি হয়েছেন আবদুল মজিদ, সাইফুজ্জামান পিকুল, একে এম খয়রত হোসেন, মোহাম্মদ আলী রায়হান, গোলাম মোস্তফা, জহুর আহম্মেদ, এবিএম আহসানুল হক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী ও জহিরুল ইসলাম চাকলাদার, কোষাধ্যক্ষ মঈনুল আলম। এছাড়া ১৯ উপদেষ্টা ও ৩৫ জন সদস্যের মধ্যে হাতে গোনা ৫-৬ জন অংশ নেয়। বাকি ২০ থেকে ২৫ জন সক্রিয় যে নেতারা রয়েছেন, তারাও গ্রুপিংয়ের কারণে প্রতিটি প্রোগ্রামে অংশ নেয় না।
জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি বলেন, ‘দলের ভিতরে কোন শৃঙ্খলা নাই। দলের যে সাংগঠনিক কার্যক্রম সেটা সভাপতি সম্পাদকের মধ্যে নাই। কমিটি গঠনের পরে কোন সাংগঠনিক সভা হয়নি। সকল সিদ্ধান্ত সভাপতি সম্পাদক নেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা একেএম খয়রাত হোসেন বলেন, ‘দলের কোন শৃঙ্খলা নাই। সিনিয়রদের মূল্যায়ন করা হয় না। দলের ত্যাগীদের বাদ দিয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতার কর্তৃত্ব বেশি। দলে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বলয় সৃষ্টি করতে যে যার মতো কমিটি বানিয়েছে। অন্যদের মূল্যায়ন করে না। তাই দলের সভা সমাবেশে যাওয়া হয় না।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। দলের নেতাকর্মীরা অনেক আরাম আয়েশে রয়েছে তাই দলের কর্মসূচিতে আসে না। দলে কোন্দল নেই দাবি করেন তিনি। দ্রুতই উপজেলার সকল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলবো।’