হাসান আদিত্য
এক দশকের বেশি সময় ধরে যশোরের রাজনীতিতে শাহীন চাকলাদার ও কাজী নাবিল আহমেদের মধ্যে দা-কুমড়ো সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্বের রেশ ছিল দুই শীর্ষ নেতার নেতাকর্মীদের মধ্যেও। তাদের সবাইকে কখনো একই কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এমনকি সরকার পতন ঠেকাতে দলটির নেতাকর্মীদের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এক হতে দেখা যায়নি। অথচ জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনার মামলায় দুই পক্ষই একত্র হয়ে ঘটনাটি ঘটেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। যা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তো বটেই রাজনীতি সচেতন মহলের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রোববার কোতয়ালী মডেল থানায় জেলা বিএনপির সাবেক সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমএ গফুর মামলাটি দায়ের করেন। বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ ও শাহীন চাকলাদারের অনুসারী ৬৩ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ১০০-১৫০জনকে। বিষয়টি নিশ্চিত করে কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আসামিরা পলাতক রয়েছে। কাউকে আটক করা হয়নি।’
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘যারা বিএনপি অফিসে হামলা চালিয়েছিল তারা আওয়ামী লীগের কেউ নয়, অতিউৎসাহী ছিলেন। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে ঘটনায় জড়িত নয়, এমন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য মামলা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে যশোরের রাজনীতির চিত্র যশোরবাসী জানে। অথচ দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের নামে মামলা হলো। মামলাটি নিয়ে নেতাকর্মী তো বটেই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’
এজাহারে বাদীর অভিযোগ, আসামিরা সকলের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী। গত ৪ আগস্ট আসামিরা সকলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে একত্রিত হয়। এরপর তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে যায় শহরের লালদিঘীর পাড়ের জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে যান। এরপর তারা পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালায়। এসময় অফিসে থাকা দুইটি ল্যাপটপ, আলমারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র লুট করে। এছাড়া প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এরপর তারা অফিসে পেট্রোল ঢেলে আগুন জালিয়ে দেয়। এরপর আসামিরা বোমা হামলা চালায়। তারা ৪০ মিনিট তাণ্ডব চালায়। এসময় অফিস সহকারী মনিরুল অসুস্থ হয়ে পড়ে। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয় আসামিরা আওয়ামী লীগের শাসন আমলে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, মাদকসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
আসামিরা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান বিপু, যশোর পৌর ছয় নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলমগীর কবির সুমন, পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন রাজিব। নাবিল অনুসারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মঈন উদ্দিন মিঠু, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, লেবুতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলিমুজ্জামান মিলন, নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজু আহম্মেদ, রামনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহামুদ হাসান লাইফ, যশোর পৌরসভার চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহিদ হোসেন মিলন ওরফে টাক মিলন, সাত নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়ন, শাহাজাহান কবির শিপলু, বিরামপুরের হাদিউজ্জামান চিমা, বারান্দিপাড়ার সনি।
এছাড়া দুই পক্ষের অন্য আসামিরা হলেন ঘোপের সুজন, রাসেল, রেজওয়ান, হাশেম কাজী, বারান্দিপাড়ার কসাই মনির, নান্টু, তৌসিফুর রহমান রাসেল, আনোয়ার হোসেন সবুজ, নুরপুরের সাগর খাঁ, ছাতিয়ানতলার আব্দুল মান্নান মুন্না, আলমনগরের টিপু সুলতান, বিরামপুরের শাহাজান আলী কসাই, ছোট হৈবতপুরের সিদ্দিকুর রহমান, তালবাড়িয়ার আসমত আলী চাকলাদার, শালিয়াটের ইমলাক, আরএনরোডের কালো ফারুক, পল্টু, এজাজ আহম্মেদ, তালবাড়িয়ার ফিরোজ, আরএন রোডের টিপু সুলতান, উপশহরের সাগর, সুলতানপুরের ডেঞ্জার দিপু, তালবাড়িয়ার টিপু সুলতান, বারান্দিপাড়ার কামাল হোসেন, পুরাতন কসবার মামুন করিম, রায়পাড়ার রিয়াজ, টেরা চঞ্চল, বালিয়াডাঙ্গার রবিউল ইসলাম, বাদশা মিয়া, চাঁচড়া ভাতুরিয়ার শফিয়ার রহমান, আজাদ, তফসিডাঙ্গার মামুন, সিরাজুল, চাঁচড়ার সোহান, বারান্দিপাড়ার গোলাম কিররিয়া সানি, হামিদপুরের টেরা সুজন, অম্বিকা বসু লেনের টেরা মোস্তফা, রায়পাড়ার সাইফুল ইসলাম, বাপ্পী, ষষ্টিতলার সিকদার, সিটি কলেজপাড়ার নাহিদ, সাদ্দাম, গোলপাতা মসজিদ এলাকার জুয়েল, বিপ্লব, শংকরপুরের মানিক, মুরগী ফার্ম গেটের রাজু, আনসার ক্যাম্পের রোহান, শংকরপুর মহিলা মাদ্রাসা এলাকার শয়ন ও পুরাতন কসবার মাসুম করীম।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। এক গ্রুপের নেতৃত্বে যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। অপর গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার। মাঠের রাজনীতিতে দুই গ্রুপের দা-কুমড়ো সম্পর্ক ছিল। তাদের সবাইকে সম্প্রতি কখনো একই কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। মামলার আসামিদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের ওই দুই গ্রুপের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে, বিএনপির অফিসে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের মিছিল থেকে অনুসারীরা অংশ নেন বলে ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণে যাদের নাম পেয়েছি এজাহারে তাদের নাম দেয়া হয়েছে। হামলায় কে ছিল, কে ছিল না সেটা পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবে।