হাসান আদিত্য
সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে যশোর শহরের দক্ষিণ অংশ। দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ অঞ্চলের জলবদ্ধতার প্রধান তিনটি কারণ শনাক্ত করেছেন এই প্রতিবেদক। জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দেড় কিলোমিটারের একটি খাল বেদখল, রেললাইনের তিনটি কালভার্ট বেদখল করে ভরাট এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন। বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসক ও পৌর কর্তৃপক্ষ বেদখলকৃত খাল, কালভার্ট উদ্ধার ও সংস্কারের আহ্বান জানালেও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এ অঞ্চলের মানুষে দুর্ভোগ থেকে গেছে।
খাল দখল ও ভরাট :
শহরের ভেতর দিয়ে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নামে দুটি নদ-নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভৈরব নদ দিয়ে শহরের উত্তরাংশ ও মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে শহরের দক্ষিণাংশের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু গত এক যুগ শহরের দক্ষিণাংশের পানি মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে নামতে পারছে না। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে ৯০ শতাংশ জলাবদ্ধতা দূর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
শহরের দক্ষিণাংশের পৌরসভার নির্মিত পয়ঃনিষ্কাশন নালা (ড্রেন), রেলের তিনটি কালভার্ট ও শহরের গাজীর বাজার-চাঁচড়াগামী সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের মাধ্যমে পানি মুক্তেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে খালটির বিভিন্ন জায়গায় মাটি ফেলে আড় বাঁধ দিয়ে চলাচলের অস্থায়ী রাস্তা নির্মাণ করেছে স্থানীয়রা। প্রায় ১৫ ফুট চওড়া খালটি ময়লা আর্বজনা ফেলে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানা স্থাপনা নির্মাণ করায় খাল এখন মৃতপ্রায়। ব্যক্তি মালিকানা ও বেসরকারিভাবে ভরাট দখল হয়ে থাকলেও এতোদিন সংস্কার বা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে পানি মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে নামতে পারছে না। উল্টো এবার সড়ক উন্নয়নের নামে ভরাট করা শুরু করেছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। যশোর ঝিনাইদহ মহাসড়কের ছয় লেন উন্নতি করণে এই অংশের খালটি ভরা করার কাজ শুরু হয়েছে। ফলে খালটি একেবারেই ভরাট হয়ে গেলে পানি নিষ্কাশিত একে বারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পৌর কর্তৃপক্ষ। গত বছর পয়ঃনিষ্কাশন নালার জায়গা রেখে খালটি ভরাট করার অনুরোধ জানিয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে পৌরকর্তৃপক্ষ। যদিও সদুউত্তর পায়নি পৌরকতৃপক্ষ।
রেলের তিনটি কালভার্টের দুটি ভরাট, অন্যটি বেদখল :
শহরের দক্ষিণাংশের বুক চিরে খুলনা-বেনাপোল ও খুলনা-ঢাকা রুটের রেল লাইন রয়েছে। এই রেল লাইনের কারণে এই অংশে তিনটি কালভার্ট রয়েছে। পাঁচ থেকে সাত ফুটের কালভার্ট তিনটি নির্মাণ হয় বিটিশ আমলে। খড়কি কলাবাগান, পশ্চিমপাড়া ও খড়কি পীরবাড়ি কবরস্থানের সামনে এই তিনটি কালভার্টের অবস্থান। এর মধ্যে খড়কি কলাবাগান ও পশ্চিমপাড়ার কালভার্টটি ভরাট হয়ে গেছে। ভরাট হওয়ার কারণে বর্তমানে খুব ধীরগতিতে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে। আর খড়কি পীরবাড়ি এলাকার কালভার্টটির দুইমুখ বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, তিনটি কালভার্ট দিয়ে খড়কি অঞ্চলের পানি খাল দিয়ে চাঁচড়া মোড় দিয়ে মুক্তেশ্বরী নদীতে পড়তো। কিন্তু এখন তিনটি কালভার্টের মধ্যে দুটির মুখ ছোট হয়ে গেছে। আর পীরবাড়ি এলাকার কালভার্টের সামনে একটি জলাশয় ও জায়গা রয়েছে। সেই জলাশয় ও জায়গাটি রেলবিভাগের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী লিজ নিয়েছেন স্থানীয় হাসান মিলন মিনু। মাছ চাষের জন্য তিনি কালভার্টের মুখ বন্ধ করে রেখেছেন অভিযোগ পৌরসভার।
পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, পীরবাড়ি এলাকার কালভার্টটি বন্ধ থাকার ফলে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে নিষ্কাশনের জায়গা খুলে দেওয়ার জন্য গেলেও তাদের বাঁধার মুখে পৌরসভা ফিরে আসতে হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের চার এপ্রিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দেয় যশোর পৌরসভা। চিঠিতে জলাবদ্ধতার মূল কারণ উল্লেখ করে ড্রেন ও কালভার্টের উদ্ধারের সহযোগিতা কামনা করা হয়। একই সাথে পীরবাড়ির সামনে দিয়ে পাকা ড্রেন নির্মাণের অনুমোদন ও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সহায়তা কামনা করে পৌরসভা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন স্থানীয় হাসান মিলন মিনু। তিনি বলেন, ‘আমরা কোন কালভার্ট বন্ধ করিনি। পুরনো কালভার্ট দেবে গেছে। পরে রেলবিভাগ ঢালাই করে দেওয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
হাসান মিলন মিনুর ভাই মঈউদ্দিন রোম দাবি করেন, ‘ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি পশ্চিম দিকের পানি পূর্ব দিকে যেতে। এখন পৌরসভা পূর্ব দিকের পানি উল্টো পশ্চিম দিকে আনবে। সেই পানি কখনো যাবে না। তাছাড়া খাল দিয়ে যে পানি বের হবে, সেই খালও ভরাট হয়ে গেছে। আগে খাল উদ্ধার ও পশ্চিম দিকে সংস্কার করুক। তার আাগে আমার জায়গাতে অভিযান চালাচ্ছে কেন।’ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনার কারণে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এতে ভোগান্তি বেড়েছে শহরবাসীর।
জলাবদ্ধতায় নাকাল :
আবহাওয়া অফিস জানায়, যশোরে গত তিন দিনে ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেঘের ঘনঘটা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তিনদিনের বৃষ্টিতে খড়কি অঞ্চলে জলাবদ্ধতার দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে শহরে খড়কি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শাহ আবদুল করিম সড়কের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এম এম) কলেজের দক্ষিণ ফটক (গেট) থেকে খড়কি মোড় হয়ে পীরবাড়ি, কবরস্থান পর্যন্ত বৃষ্টির পানি জমেছে। ওই এলাকা দিয়ে চলাচলের সময় রিকসা, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাসের চাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। পায়ের জুতা হাতে নিয়ে অনেককে হেঁটে চলাচল করতে দেখা যায়। কলেজে আসা শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লক্ষ্য করা গেছে। খড়কি দক্ষিণপাড়া-পশ্চিমপাড়া হাজামপাড়া, খড়কি রেললাইন পাড়ার বাসিন্দাদের বাড়ির উঠানে হাঁটি পানি।
খড়কি কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম, রুহুল আমিন বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে এই এলাকাতে বাস করি। আগে জলাবদ্ধতা হতো না। এখন ইচ্ছামতো বাড়িঘর, দখল করেছে। কালভার্ট দখল, সরু আর পানি বের হওয়ার খালও মরে গেছে। এর ফলে অল্প বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় এলাকাটি। ভারী বৃষ্টি হলে দুই তিনদিনও লাগে ঠিক হতে।
খড়কি পীরবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘অন্য ওয়ার্ডের বৃষ্টির পানি আসা, খালগুলো দখল ও সংকুচিত হওয়া, অপর্যাপ্ত নর্দমাব্যবস্থার অভাব, বক্স-ড্রেনের নামে খালনালা হত্যাসহ পর্যাপ্ত পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন শহরের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। ওই পানি বের করার জন্য খালের মাধ্যমে মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু পৌরসভা গত এক যুগেও সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি।’
খড়কি এলাকার বাসিন্দা প্রবীন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘খড়কি এলাকাটা শহরের অন্য জায়গার চেয়ে তুলনামূলক নিচু। রাস্তার পাশে পয়ঃনিষ্কাশনের নালা দিয়ে অন্য এলাকার পানি আসে। ওই পানি বের হতে পারছে না। আবার পানি বের হওয়ার কালভার্ট দখল, খাল ভরাটের কারণে পানি বের হতে পারছে না। পানি জমে থাকায় বিটুমিনের আস্তরণ উঠে রাস্তার মধ্যে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পৌরসভার দারস্থ হলেও এক যুগেও সমাধান হয়নি।’
যা বলছে কর্তৃপক্ষ :
পাঁচ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজিবুল আলম বলেন, ‘নির্বাচিত হয়ে আমার প্রধান কাজ ছিলো ওয়ার্ডটিতে জলাববদ্ধতা দূর করা। ওয়ার্ডটিতে জলাবদ্ধতার কারণ পীরবাড়ি এলাকার কালভার্ট বন্ধ থাকার কারণে। কালভার্টের পাশে রেলওয়ের জমি রয়েছে। সেই জমি লিজ নিয়েছেন পীরবাড়ির পরিবার। তাদের কারণে ওই জায়গায় পাকা ড্রেন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে গেলেও বাধার মুখে ফিরে আসতে হয়েছে।’
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শরীফ হাসান বলেন, ‘খড়কি অঞ্চলে রেলের কালভার্ট দখল ও ভরাটের কারণে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। আবার খালও ভরাট হয়ে গেছে। আমরা দুটি দপ্তরকেই চিঠি দিয়েছি। তারা আন্তরিক না হলে সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এছাড়া শহরবাসীর অসচেতনতার কারণেও নালার পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা ও নালা সংস্কার ও নির্মাণের জন্য এমজিএসপি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’
যশোর রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী গৌতম বিশ্বাস বলেন, ‘আমি কালভার্টটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। যেদুটি সংস্কারের দরকার সেটা আমরা দপ্তরে জানিয়েছি। আর যে কালভার্টটি দখলে রয়েছে। সেটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, পীরবাড়ি আন্তরিক হলেই ওই স্থানের জলাবদ্ধতা সমাধান হবে।’