বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় উত্তেজনা বাড়ছে। বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর কর্ম সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। নির্বাচনের পর দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মীকে গুলি করে এবং অপর পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মীকে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় আতংক বেড়েছে। পরিবারের সদস্যদের দাবি, সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, জমিজমা নিয়ে পূর্ব বিরোধের জের ধরে হত্যা সংঘটিত হয়েছে। দুটি ঘটনায় এখনো কোন মামলা হয়নি, কাউকে আটকও করা হয়নি। ঘটনার পর থেকে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফের এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে পারে বলে স্থানীয়রা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা আওয়ামী লীগকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এই সহিংসতা তৃণমূলে যে বিভেদ ছিলো, সেটি স্থায়ী বিভেদ তৈরি করলো। যার ফলে দলটির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। গত বুধবার (৫ জুন) চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিত হয় যশোর সদর উপজেলা নির্বাচন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মোটরসাইকেল প্রতীকের তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু নির্বাচিত হন। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনী পরবর্তী সহিসংসার ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার (৬ জুন) দিবাগত রাতে যশোরের সদর উপজেলার বাহাদুরপুর তেঁতুলতলা এলাকায় বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে দুবৃর্ত্তরা। নিহত মোহাম্মদ আলী হোসেন (৩৫) বাহাদুরপুর এলাকার পশ্চিমপাড়ার রহমত আলীর ছেলে। পুলিশ জানিয়েছে নিহত মোহাম্মদ আলী হোসেনের বিরুদ্ধে মাদক, মারামারি ও দ্রুতবিচার আইনে চারটি মামলা রয়েছে। মোটরসাইকেল প্রতীকের বিজয় উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে বাহাদুরপুর এলাকায় পিকনিকের (খাওয়া-দাওয়া) আয়োজন করেন মোহাম্মদ আলী ও তার সহযোগীরা। খাওয়া দাওয়া শেষে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। রাত দেড়টার দিকে পথিমধ্যে ৪-৫জন যুবক তাকে ধাওয়া করে ধরে মাথায় একাধিক গুলি করে পালিয়ে যায়।
পরে স্থানীয়রা মোহাম্মদ আলী হোসেনকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডাক্তার মোহাম্মদ সুজায়েত জানান, হাসপাতালে আসার আগেই আলী হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় দুটি ও পায়ে একটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।’
সদর উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের আহবায়ক ও চেয়ারম্যার হুমায়ুন কবীর তুহিন বলেন, নিহত আলী হোসেন যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান তৌহিদ চাকলাদারের পক্ষে কাজ করেন।
আলী হোসেনের বাবা রহমত আলী বলেন, ‘নির্বাচন ঘিরে একই এলাকার ঘোড়া প্রতীকের নবাব ও সিরাজের সঙ্গে আমার ছেলের বিরোধ হয়। তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচনী সহিংসতায় আহত হওয়া দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী সাকিব হোসেন (১৮) ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান। তিনি সদরের চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকার মজনু মিয়ার ছেলে। গত ৫ জুন অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে দোয়াত-কলম প্রতীকের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন বিপুলের কর্মী ছিলেন।
নিহত সাকিবের মামা শহিদ রহমান বলেন, বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে চাঁচড়ায় বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুর কর্মী সমর্থকরা বিজয় মিছিল বের করে। এ সময় দোয়াত-কলমের ৫/৬ জন কর্মী তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তারা কয়েকজনকে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় স্থানীয় জনতা তাদের ধাওয়া করে। কিন্তু সাকিব পালাতে পারেনি। সে জনতার গণপিটুনীতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তাকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ওই রাতেই তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ঢাকায় রেফার করেন চিকিৎসকরা। অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে ঢাকায় নেয়া হয়, কিন্তু একটি দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন সাকিবের স্বজনরা। তাকে ঢাকা মেডিকেলে না নিয়ে চক্রটি একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে বৃহস্পতিবার দুপুরে দিকে কিশোর সাকিবের মৃত্যু হয়।
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চাঁচড়া ও বাহাদুরপুর এলাকার ঘটনায় যে দুজন মারা গেছে নির্বাচনী সহিংসতা নয়। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তারা নিহত হয়েছেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এছাড়াও যশোর সদরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় এক যুবলীগ কর্মীর বাড়িতে হামলা, মারপিট, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে। শুক্রবার একই উপজেলার গাইদগাছি গ্রামে এই ঘটনার পর ভুক্তভোগী ইকরাম গাজী দুইজনের নাম উল্লেখ পূর্বক অজ্ঞাতনামা আরো ৩/৪ জনের বিরুদ্ধে এদিনই কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযুক্তরা হলেন, একই গ্রামের অরো কুন্ডুর ছেলে অয়ন কুন্ডু ও জাহিদুল মোল্লার ছেলে জনি।
এ বিষয়ে বসুন্দিয়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই আসাদুজ্জামান বলেছেন, বিষয়টি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, যশোরে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা আওয়ামী লীগকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এই সহিংসতা তৃণমূলে যে বিভেদ ছিলো, সেটি স্থায়ী বিভেদ তৈরি করলো বলো জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী। নাম না প্রকাশে জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘বিএনপি ছাড়া উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের স্বতন্ত্র নির্বাচন করার অনুমতি দেয়া হয়। সেই উদ্দেশ্য সফল হলেও নির্বাচনের পরের সহিংসতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। তৃণমূলে দীর্ঘদিনের যে বিভেদ ছিলো, সেটি আরো দীর্ঘতর হচ্ছে। একই সাথে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় নিহত পরিবারগুলো অসহায় অবস্থায় আছেন। তারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে দায়ী করছেন।’
তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তিনি বলেন, ‘যশোরে নির্বাচনকালীন যে দুজন নিহত হয়েছেন ঘটনাটি দুঃখজনক। এসব বিছিন্ন ঘটনা। তারা আমাদের দলের কেউ না। এসব ঘটনার সঙ্গে নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই। নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকলেও দলের প্রশ্নে সব এক।’