স্বাধীন মুহম্মদ আব্দুল্লাহ
ভালোবাসা মানে না ধর্ম, বর্ণ, জাত, গোত্রের বাঁধা। ভালোবেসে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমানো যায় প্রিয় মানুষের কাছে শুধুমাত্রই ভালোবাসার টানে। কিংবা বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষ্ণবর্ণের একটা মেয়েকে ভালোবেসে রাজ রাজত্ব ছেড়ে, আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সবুজ শ্যামল এ দেশের কাঁদা মাটি জলে মিশে থাকা যায় দীর্ঘ বছর।
তেমনি ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ক্রিস্টফার মার্ক হোগল ও রহিমা খাতুন। তারা একে অপরকে ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন প্রায় এক যুগ। এ দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে তাদের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। হাতে হাত ও চোখে চোখ রেখে আমৃত্যু এক সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতে চান তারা। তাদের এ ভালোবাসার সঙ্গে অন্য কোন জুটির তুলনা করতে চায়নি। রহিমা-হোগল দম্পতির ভালোবাসাকে যেন আগামী প্রজন্ম স্মরণ করে এমন দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চান।
বলছিলাম, যশোরের কেশবপুরের অজপাড়াগা মেহেরপুর গ্রামের রহিমা খাতুন ও আমেরিকার পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের কথা। ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল একে অপরকে ভালোবেসে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রহিমাকে বিয়ে করে হোগল আর ফিরে যাননি আমেরিকায়। বসবাস করছেন মধুকবির স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদ তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গড়ে ওঠা মেহেরপুর গ্রামেই। ক্রিস্টফার মার্ক হোগল এখন আয়ুব হোসেন নামে পরিচিত।
কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি ইউনিয়নের মেহেরপুর গ্রামে ওই দম্পতির বাড়িতে গেলে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন একটি বহুতল ভবনের কাজ চলছে। আমেরিকার পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টফার মার্ক হোগল বাড়ির উঠানে বসে গরুর জন্য খাবার কাটছেন। রহিমা খাতুন উঠানের পাশেই গরু ও ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য ঘাস পরিচর্যা করছেন। জানতে পারলাম, ক্রিস্টফার মার্ক হোগল কিছুটা বাংলা বলতে পারেন ও বোঝেন। ইংরেজিতে কথা হলে ক্রিস্টফার মার্ক হোগল জানায়, তার বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। পেশায় তিনি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার। রহিমা খাতুনের সঙ্গে ভারতের আসানসোলে তাদের প্রথম পরিচয় হয়। পরে তাঁরা একে-অপরকে ভালোবেসে ফেলেন। ভালোবাসার একপর্যায়ে ছয় মাস পর তারা ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার আমেরিকায় এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। আমেরিকার স্ত্রীর সঙ্গে তার অনেক আগেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। সেখানকার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
এ সময় রহিমা খাতুন স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি ছোটবেলায় বাবা-মায়ের হাত ধরে ভারতে যান। সেখানে তাঁরা কাজ করতেন। তাঁর বয়স যখন প্রায় চৌদ্দ বছর তখন তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর তিন সন্তান হলে তার ওই স্বামী তাদেরকে রেখে অন্যত্র চলে যায়। তখন তিনি জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে গেলে ক্রিস্টফার মার্ক হোগলের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয়। বিয়ের পর হোগল তাকে নিয়ে চীনে যান। সেখানে ৫ বছর থাকার পরে হোগলকে নিয়ে নিজের জন্মভূমিতে নিয়ে আসেন। বর্তমানে মেহেরপুর গ্রামে তারা প্রায় ৪ বছর ফিরে এসে বসবাস করছেন। তার স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজি, হিন্দি ও চায়না ভাষা রপ্ত করেছেন। তিনি মেহেরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল খাঁ ও নিছারুন বেগমের মেয়ে।
রহিমা খাতুন আরও বলেন, তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এভাবেই এক-অপরকে ভালোবেসে থাকতে চান। তিনি আমেরিকার দুই সন্তানকেও মেহেরপুরের বাড়িতে আনবেন।
কথা প্রসঙ্গে ক্রিস্টফার মার্ক হোগল বলেন, তিনি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে জানেন। তার কবিতা পড়েছেন। মহাকবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি বেড়াতে গেছেন। বাড়ির পাশে মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারেরও তিনি নিয়মিত যাতায়াত করেন। তিনি আধো আধো বাংলায় বলেন, আমি রহিমাকে খুব ভালোবাসি। বাংলাদেশ খুব ভালো জায়গা। এ গ্রাম আমার ভালো লাগে।
রহিমার বড় ছেলের স্ত্রী তামান্না খাতুন বলেন, শ্বশুর ক্রিস্টফার মার্ক হোগল (আয়ুব হোসেন) তাদেরকে খুবই ভালোবাসেন। তার ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। এলাকার মানুষের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে মন জয় করেছেন। তাকে কোন কাজ একবার দেখিয়ে দিলেই করতে পারেন। তিনি কৃষি কাজসহ গরু-ছাগল পালন করছেন। বাড়িতে ৭টি গরু ও ৯টি ছাগল নিজ হাতে দেখাশোনা করেন। তিনি এবার ১৫ কাটা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন।
মুন্সি মেহেরুল্লাহ মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বলেন, রহিমা ও হোগলের এ ভালোবাসার কাহিনী সকলের মুখে মুখে। হোগল (আয়ুব আলী) খুবই ভালো মানুষ। তিনি মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। দেখলে আগে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। আমরা এমন একজন বিদেশী মানুষকে পেয়ে খুবই খুশি।