- নারী পুরুষ শিশুরা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয় পাশের বিলে
- আতংকে বাড়ি ফিরেনি পাড়াটির পুরুষ সদস্যরা
- তরিকুলের দাফন সম্পন্ন, মামলা হয়নি
হাসান আদিত্য
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহরমশিয়াহাটি গ্রামের বাড়েদা পাড়া। ভবদহ অঞ্চলের বিলের মধ্যে পাড়াটির অবস্থান। এই পাড়াটিতে দোচালা টিনের বাড়িতে এক ছেলেকে নিয়ে বসাবস করতেন মহিতুল বিশ্বাস ও স্মৃতি বিশ্বাস দম্পতি। সনাতন ধর্মাবলম্বীর মতুয়া সম্প্রদায়ের এই বাড়িতে বৃহস্পতিবার রাতে চলছিল পূজা অর্চনা। এমন মূর্হুতে কয়েকজন দুবৃর্ত্ত বাড়িতে এসে হামলা চালায়। প্রথমে লুটপাট, পরে অগ্নিসংযোগ করে। দুবৃর্ত্তদের দেয়া আগুনে দুটি ঘরের সকল জিনিসপত্র পুড়ে ছাই স্মৃতি বিশ্বাসের। নিস্তার পায়নি পাশের অবলা প্রাণীদের গোয়ালঘরটিও। সেখানেও অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সবকিছু।
হামলা লুটপাটের ভয়বহতায় পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের বিলে। ততক্ষণে ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বছরের পর বছর তিলে তিলে জমানো স্মৃতি বিশ্বাসের সাজানো সংসার। মাথার গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে উঠানের এক কোণে হয়েছেন শয্যাশায়ী। আতংকে এখনোও বাড়ি ফিরেনি ছেলে ও স্বামী।
স্মৃতি বিশ্বাস বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে আমার বাড়িতে পূজা চলছে। বিভিন্ন দল তাদের ধর্মীয় কীর্তন করছিলেন। বিভিন্ন বাজনা বাজছিলো। হঠাৎ ৬ থেকে ৭ জন আমার বাড়িতে এসে কিছু না বলেই ভাংচুর করে। গালিগালাজ করতে থাকে। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। আমারও মারধর করেছে। আগুন ধরাতে শুরু করতেই ভগবানের নাম নিতি নিতি প্রাণে বাঁচতে দৌড় দিলাম বিলের দিকে। বনজঙ্গল জল মাড়িয়ে বিলের এক ঢিবেতে লুকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে দেখছি আমার বাড়িঘর আগুনে পুড়ছে। সকালে ফিরে এসে দেখি কিচ্ছু নেই। বাড়িতে দুটো মোটরসাইকেল ছিল, সেটাও পুড়ে ছাই। ঘরের ভিতর বাক্স ভাঙ্গা, তার ভিতরে কাপড় চোপড় আগুনে পুড়ে গেছে। ঘরের টিন পুড়েছে। স্বর্ণলংকার নিয়ে গেছে। আগুন দেওয়ার আগে তারা বাড়িঘর লুটপাট করেছে। গরু ছাগলের ঘরও পুড়ে ছাই। পরণে কাপড় ছাড়া আমার আর কিছু নেই।’
স্মৃতি বিশ্বাসের মত ক্ষোভের আগুনে পুড়ে গেছে বাড়েদাপাড়ার নিরীহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ১৩ পরিবারের ১৮টি ঘরবাড়ির সর্বস্ব। অগ্নিসংযোগের আগে লুটপাট চলে এসব বাড়িতে।
স্থানীয়রা জানান, অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম সরদার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘের লিজ নেয়ার জন্য ডহরমশিয়াহাটির বাড়েদা পাড়াতে পিন্টু বিশ্বাসের বাড়ি যান। সেখানে চুক্তিপত্র করা সময় গোলযোগ হলে অজ্ঞাত ৭/৮ দুর্বৃত্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছে কুপিয়ে ও গুলি করে তরিকুলকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর তরিকুলের সমর্থকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তারা পিন্টু বিশ্বাসের তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, অজ্ঞাত লোকজন দল বেঁধে এসে পিল্টু বিশ্বাসের প্রতিবেশিদের বাড়িতেও ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ভয়ে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেয় বিলে ঝোপঝাড়ে। এরপর দূর থেকে দেখতে পান তাদের বাড়ি ঘরে আগুন জ্বলছে। সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন ধানের গোলা, বসত ঘর, রান্না ঘর, গোয়ল ঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
শুক্রবার বিকালে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, যতদূর চোখ যায়, চারিদিকে ঘরবাড়ির জিনিসপত্র পোড়ার ছাই। কারোও বাড়ির ঘরের ইট আছে শুধু, ঘরের ছাউনি, তার ভিতরে জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে আছে। পাড়াটিতে বেশির ভাগ বাড়ির পুরুষ শুণ্য। দূরদুরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনেরা দলবেঁধে খাবার নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে আসছেন। পাড়াটিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। প্রতিটি বাড়িতে উনুন জ¦লেনি শুক্রবার রাত অবধি। নিরাপত্তা দিতে মোড়ে মোড়ে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। মাঝে মাঝে আসছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। তার পরেও আতংক কাটেনি মতুয়া সম্প্রদায়ের এই পাড়ায়।
পাড়াটির মধ্যে বাড়িটি চন্ডিকা বিশ্বাসের। তাদের দুটি বাড়ি পুড়ে গেছে। পোড়া বাড়ির মেঝেতে শয্যাশায়ী তার শাশুড়ি। উঠানের পেয়ারা গাছের নিচে কপালে হাত নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে পঞ্চাশ বছর বয়সী চন্ডিকা বিশ্বাসের। বাড়িতে কোন পুরুষ লোকজন বলে জানান।
জানতে চাইলে বলেন, ‘কিছু বলার নেই। কি বলবো! যা যাওয়ার তো আমাদের চলে গেছে। আমরা কি অপরাধ করেছি। নিরীহ গরীব আমরা। যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি দিক। আমরা তো কোন অপরাধ করেনি। তাহলে আমাদের কেন পোড়ালো।
হামলার ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে এই নারী বলেন, ‘যখন হামলা হয়, তখন ছেলে, ছেলের বেটার বউ আর আমার স্বামী বিলের জল মাড়িয়ে পাশের গ্রামে চলে যায়। আমার শাশুড়ি অসুস্থ, তাদের বলছে, তোমরা আমাদের ঘরে যা আছে নিয়ে যাও, তারপরেও আগুন দিয়ে না। তার পরেও লুটপাট করে আগুন দিয়ে তারা চলে যায়। আমাকে গালাগালি দিয়ে তেড়ে মারতে আসলে আমি দূর থেকে সব দেখছিলাম।’
সবার আগে আগুন দেয় পরিতোষের বাড়িতে। তিনি বলেন, কোন রকম জানডা নিয়ে পালিয়ে ছিলাম। জামা গেঞ্জি পড়ার সময়টুকুও পায়নি। বাড়িতে বুড়ো মা বাবা ছিলো, তাদের ফেলে চলে গেছিলাম। তার দাবি, আগুন লাগছে, ফায়ার সার্ভিসের লোকদের জানানো হয়, হামলাকারীরা তাদের আসতে দেয়নি। ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়ে গেছে। আগুনের আঁচে গাছের পাতাও পুড়ে গেছে। আমরা আতংকে আছি। পাড়াতে পুরুষ শূণ্য। আমরা নিরঅপরাধ এইসব মানুষদের যারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের আইননের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যশোরের বামগণতান্ত্রিক জোটের নেতা ইকবাল কবির জাহিদের নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ। এছাড়া পুলিশ সুপার রওনক জাহান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোরের নেতৃবৃন্দরা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই বিষয়ে পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।
অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলীম জানান, তরিকুল হত্যাকে কেন্দ্র করে কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটনা ঘটেছে। গত রাতেই পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রন করে। তিনি আরো জানান, ঘটনার সাথে জড়িতদের সনাক্তের চেষ্টা চলছে এবং এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হত্যাকান্ডের ঘটনা ও আগ্নিকান্ডের ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। তবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।’
তরিকুল ইসলামের জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন:
শুক্রবার আসরের নামাজ শেষে ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মরহুমের জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তরিকুল ইসলাম উপজেলার ধোপাদী গ্রামের মৃত ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তরিকুল হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘন্টা পার হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। তবে ওই এলাকার সন্দেহভাজন দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নিয়ে গেছে পুলিশ।
এদিকে তরিকুল ইসলামের জানাজা নামাজে উপস্থিত ছিলেন, যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, কৃষক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব, অভয়নগর থানা বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান, সাধারণ সম্পাদক কাজী গোলাম হায়দার ডাবলু, নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি আবু নঈম মোড়ল, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল মোল্যা, বিএনপি নেতা মশিয়ার রহমান, জাকির হোসেন, ইমাম পরিষদ, নওয়াপাড়া সার ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ জেলা-উপজেলা বিএনপি ও সকল অঙ্গ সহযোগি সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২২ মে) সন্ধ্যায় উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের ডহরমশিয়াহাটী গ্রামের বাড়েদা এলাকায় পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে যান তরিকুল ইসলাম ও তার এক সহযোগী সুমন। সেখানে মৎস্যঘেরের জমি সংক্রান্ত চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের বিষয়ে পিল্টু বিশ্বাসের সঙ্গে তরিকুলের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জন দুর্বৃত্ত বাড়ির ভেতরে ঢুকে তরিকুল ইসলামকে কুপিয়ে ও গুলি করে পালিয়ে যায়। কৃষকদল নেতার মৃত্যুরে খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই রাতে উত্তেজিত জনতা পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িসহ আশপাশের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
শিরোনাম:
- যশোরে সবজি ও চালের দাম কমলেও স্থিতিশীল মাছ ও মাংসের দর
- দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ঐতিহ্য ধ্বংস করেছিল স্বৈরাচর আ.লীগ-তাবিথ আওয়াল
- চৌগাছায় পবিস’র ব্যর্থতায় জনদুর্ভোগ, সংস্কার দাবি এবি পার্টির
- বিএনপি তরুণদের ভাবনাকে মূল্যয়ন করছে : তাবিথ আউয়াল
- মণিরামপুরে জামায়াতের যুব সমাবেশ
- যশোরে মাদকবিরোধী ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
- ৪ দফা দাবিতে যশোরে হেফাজতের বিক্ষোভ সমাবেশ ও গণমিছিল
- বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ রঙিন: আর্জেন্টিনার অ্যাম্বাসাডর
রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়লো হিন্দুপাড়ার ১৮ বাড়িঘর, লুটপাট
অভয়নগর কৃষকদল নেতা হত্যা