- দেশে দ্বিতীয় দ্রুততম রায়
- তিন আসামিকে খালাসে অসন্তুষ্ট শিশুটির মা, ক্ষোভ এলাকাবাসীর
- একপেশে বিচার হয়েছে অভিযোগ আসামির স্বজনদের
হাসান আদিত্য, মাগুরা থেকে ফিরে
মাত্র ১৪ কার্যদিবসে শেষ হলো মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়। শুনানি শেষে মামলার প্রধান আসামি ও শিশুটির বোনের শ্বশুর হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সাথে তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য তিন আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসান এ রায় ঘোষণা করেন।
সকাল থেকে চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায়কে ঘিরে আদালত চত্বর ছিলো সরগরম। পৌনে ৯ টার দিকে পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে প্রিজন ভ্যানে আনা হয় মামলার চার আসামিকে। ঠিক এক ঘন্টা পর আসে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম রায়। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, মেডিক্যাল এভিডেন্স ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আর বাকি তিন আসামি শিশুটির বোনের স্বামী, তার ভাই ও তাদের মায়ের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাস দেয়া হয়েছে।
কলঙ্কমুক্ত মাগুরা:
শিশু আছিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে কাঁদিয়েছিল গোটা দেশকে। তাইতো এ রায়কে ঘিরে সবার চোখ ছিল মাগুরার দিকে। এ রায়ের মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে মাগুরা; অন্যদিকে দ্রুততম রায়ের এই উদাহরণ আদালতে মামলাজট কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিচারপ্রার্থীরা। রায় ঘোষণার সময় আসামিদের পাশাপাশি মামলার বাদী শিশুটির মা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন আসামিদের স্বজনেরা ও আইনজীবীও।
রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) মনিরুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘মূল আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে অন্য তিনজনকে কেন খালাস দেয়া হয়েছে, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমরা জানতে পারব। সেটা পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে আপিলের বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
আসামি পক্ষের আইনজীবির প্রতিক্রিয়া:
রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী (লিগ্যাল এইড অফিস থেকে নিয়োগ দেয়া) সোহেল আহম্মেদ। তিনি আদালত প্রাঙ্গনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিন আসামিকে যে খালাস দেয়া হয়েছে, তাতে আমরা খুশি। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হয়নি। আর মূল আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, তা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।’
যদিও প্রথম থেকে আসামি পক্ষ স্থানীয় ছাত্র জনতার তোপের মুখে কোন আইনজীবী তাদের পক্ষে লড়াইয়ের ইচ্ছা পোষণ করেনি। এটি একপেশে বিচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মেয়ে। তিনি আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে কোনো উকিল আমাদের পক্ষে দাঁড়াতে চায়নি। লিগ্যাল এইড থেকে একজন উকিল দেয়া হইছিল, সে আমাদের কথা আদালতে ভালোভাবে বলেনি। আমরা কয়েকজন সাক্ষী দিতে চাইছিলাম। আইনজীবী বলে, এ সাক্ষী দেয়া যাবে না। আমার আব্বার ফাঁসি দিয়ে যদি দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, হোক। কিন্তু যা হলো, তা একপেশে বিচার।’
তিনি জানান, ঘটনার পর তার বাবার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে তার দাদি অন্যের বাড়ির বারান্দায় রাত কাটান। এ ঘটনার বিচার কে করবে—এ প্রশ্নও করেন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিটু শেখের মেয়ে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন আছিয়ার মা ও প্রতিবেশিরা:
রায় ঘোষণার পরপরই আদালত চত্বর ত্যাগ করে বাড়ি চলে যান নিহত শিশুটির মা। মাগুরা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রাম। এই গ্রামের মাঝের পাড়ায় একটি টিনের ঘরে বসাবস আছিয়ার পরিবারের। বাড়ির পরিবেশ আর ভাঙাচোরার দৃশ্যই বলেই দেয় পরিবারের দারিদ্র্যতা। শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঘরের বারান্দায় এক কোনে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় আছিয়ার মায়ের। অনবরত কান্নায় যেন এখন সন্তান হারা এ মায়ের দুচোখে অশ্রু শুকিয়েছে। পাশেই তার বড় বোন জানালেন, আছিয়ারা চার ভাই বোন। বড় বোনকে বিয়ে দিয়ে ছিলেন হিটু শেখের মেঝ ছেলের সাথে। এরপর দ্বিতীয় আছিয়া। আর তৃতীয় বোন স্থানীয় বড়ালিদহ আবাসিক এক মাদ্রাসায় পড়েন। আর সবার ছোট আড়াই বছরের একটা ছোট ছেলে। স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। আছিয়ার মৃত্যুর পরে তার অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে। এই রায়ে খুশি কিনা জানতে চাইলে আছিয়ার মা তার দুই পা মেলিয়ে বসা অবস্থা থেকে একটু উঠে দাঁড়িয়ে জানালেন, ‘আমি খুশি না। এই মামলায় তিন আসামি খালাস পেল? ওরা তো এ কাজে সহযোগিতা করিছে। আমার বড় মেয়েরে হুমকি দেছে। তারে মারধোর করছে, মুখ আটকায় রাখছে। ওরাও দোষী, ওদেরও শাস্তি হওয়া উচিত। ওরা এক মেয়ের জীবন নিয়েছে। আরেকটার ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়েছে!
‘যারা এমন পাপের সাথে সহযোগিতা করেছে, তাদের কেন ছেড়ে দিলো জজ সাহেব। কোটে দেখলাম ছাড়া পাওয়া তিন জনের মুখে হাসি। তারা বের হয়ে আমাদের উপর প্রতিশোধ নিবে। টেনশনে আমার বুক কাঁপছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন, কলিজা ছেড়া ধন কষ্ট করে মানুষ করেছি। পাশবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে তারা। খেয়ে না খেয়ে মানুষ করেছি তারে। জজ সাহেব তাদের ছেড়ে দিলেও আমি সারাজীবন তাদের বদ দোয়া দিয়ে যাবো। মায়ের দোয়া কবুল করে আল্লাহ।
প্রতিবেশিরা জানান, যেভাবে শিশুটি লালসার শিকার হয়েছেন। রায়টি দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সকলকে সর্বোচ্চ রায় দেওয়া উচিত ছিল। কেননা মূল আসামির সঙ্গে অন্য তিন জনও প্রমাণ লোপাটসহ এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলো। স্থানীয়রা জানান, পার্শ্ববর্তী গ্রাম সনাইকুন্ডি কবর স্থানে দাফন করা হয় আছিয়াকে। দাফন করার পরের দিন থেকে দিনে দু’একবার করে কবরের পাশে গেলেই আহাজারি করতে করতে মুর্ছা যেত। অজ্ঞানও হয়ে যেতেন মাঝে মধ্যে। তাই পরিবারের সদস্যরা তাকে আর কবরে পাশে যেতে দেন না।
আছিয়ার খালা কোহিনুর বেগম জানান, ‘আছিয়ার বড় বোনকে একে বারের মতোই আমরা বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আছিয়ার ভগ্নিপতি খালাস পেলেও আমাদের কাছে ওই পরিবার অপরাধী। যে পরিবারের কাছে আমাদের এক সন্তানকে হারালাম; সেখানে আর আমাদের মেয়েকে পাঠাবো না। আছিয়ার পক্ষে যেসব আইনজীবী লড়েছেন; তাদের সাথে বসে দ্রুত ডিভোর্স দেয়া হবে।’
মামলার এজাহার যা জানা যায়:
শিশুটি বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। ৬ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে অচেতন অবস্থায় মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এর আগে ৮ মার্চ শিশুটির মা মাগুরা সদর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ১৭ এপ্রিল মামলাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয় এবং ২০ এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। গত ১৫ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সব্যসাচী রায়ের আদালতে শিশুটির বোনের শ্বশুর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
গত ২৭ এপ্রিল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। মামলায় শিশুটির বোনের শ্বশুরকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯/২ ধারায় (ধর্ষণের ফলে মৃত্যুর অপরাধ), শিশুটির বোনের স্বামী ও ভাশুরের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার দ্বিতীয় অংশ (ভয়ভীতি প্রদর্শন) এবং বোনের শাশুড়ির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় (অপরাধের আলামত নষ্টের অভিযোগ) অভিযোগ গঠন করা হয়। এই ঘটনার পর মাগুরাসহ সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা যায়। মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অনেকেই দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। শিশু আছিয়ার মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর বিক্ষুব্ধ জনতা ধর্ষণের দায় অভিযুক্ত হিটু শেখের বাড়িতে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ চালায়। ক্ষোভের আগুনে সেই বাড়িটি এখন নিশ্চিহ্ন অবস্থায়। শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্যতম চাঞ্চল্যকর ও মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাত্র ১৪ কর্মদিবসে বিচার প্রক্রিয়া শেষে আলোচিত এ মামলা নিষ্পত্তি করাতে দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট নিরসনের ক্ষেত্রে আশা জাগিয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, বিচার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই সম্ভব দ্রুত বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি।
দেশে দ্বিতীয় দ্রুততম রায় :
এর আগে ২০২০ সালে মোংলায় সাত বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ গঠনের সাত কার্যদিবসের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই বছরের অক্টোবরের গোড়ার দিকে বন্দর শহর মোংলায় ৭ বছর বয়সী একটি শিশুকে বিস্কুটের প্রলোভন দিয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতন করেন তারই প্রতিবেশী ৫৩ বছর বয়সী আব্দুল মান্নান সরদার। ঘটনার রাতেই শিশুটির মামা বাদী হয়ে মামলা করলে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১১ অক্টোবর জুডিশিয়াল আদালত মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠায়। পরদিন অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩ অক্টোবর বাদীপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া হয় এবং ১৪ অক্টোবর সাক্ষী, চিকিৎসক, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য নেয়া হয়। যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ। মামলা দায়েরের মাত্র ছয় কার্যদিবসে বিচারকাজ শেষ করে সাত দিনের মাথায় রায় ঘোষণা করা হয়। আর মাগুরার আছিয়া ধর্ষণ মামলার বিচার ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করার ধারণাটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ। দ্রুত বিচার ভুক্তভোগীদের দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং অপরাধীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করবে। এর ফলে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ কমতে পারে এবং আইনি ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়বে।